আলোচনা- 'বেঁচে থাকার জীবন্ত পোট্র্রেট' by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

অসংখ্য জীবন আমাদের জীবনে প্রবেশ করে আছে। তা থেকে তৈরি হয় আশা কিংবা হতাশা কিংবা স্টাইল।

বশীরের স্টাইল হালকা হাওয়ায় উড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে বশীর যেসব কাজ করেছে, সেসব থেকে তৈরি হয়েছে তার স্টাইল। যেন সব এক ধরনের এলিগ্যান্স। সব কিছু সত্ত্বেও তার কাজে একটা মেলোডি খুঁজে পাওয়া যায়। এ মেলোডিটাই তার স্টাইল। তার ভেতর থেকে আসে কিংবা তৈরি হয়। সে জন্য স্টাইল স্বপ্নের কাছাকাছি, স্টাইল সজীবের খুব কাছের। বশীর যেসব মেয়েকে ভালোবেসেছে :
ফ্লোরেন্সে কিংবা লন্ডনে কিংবা কলকাতায়, তাদের চোখে গভীরভাবে তাকিয়ে প্রজাপতির রং খুঁজেছে। সেই রঙে আছে বিষণ্নতা, পেছনে ফিরে তাকানোর তাগিদ। রংও বলা যাবে না, যাকে ভালোবাসব। সেসব বশীর খুঁজে বার করেছে প্রজাপতির ডানায় ভর করে। প্রজাপতির ডানা কোনো বিষয় নয়, কোনো বস্তু নয়, কোনো নিসর্গ নয়, এ হচ্ছে রং, রং বশীরও এঁকেছে সুষম করে, রঙের ওপর কর্তৃত্ব ভরে। এ রং হচ্ছে কোমল; কোমলতা সে ধরেছে, কোমল, তার ওজন নয়। অন্যদিক থেকে যদি ভাবি, তাহলে বলতে হয়, এসব রং ক্ষত মেলে ধরে, যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ক্ষত কিংবা তারও আগের স্পেনিক সিভিলওয়ারের ক্ষত। একটা বই থেকে যেমন আর একটা বই পড়ার সাধ জাগে, যেমন জর্জ ওরওয়েলের, ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন, কিংবা মার্সেল প্রুস্তের, সোয়ানস ওয়ে, কিংবা হেনরি মিলারের, ট্রপিক অব ক্যানসার; তেমনি বশীরের রং, রঙের যোজনা, একটা বোঝাপড়া হয় তার রঙের সঙ্গে আমার চোখের, রঙের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি বশীরের খুব কাছে চলে আসি। বশীর পেইন্টার এবং রাইটার, আমি রাইটার এবং শিল্প সমালোচক। আমরা এভাবে পরস্পরকে হোমেজ জানাই।
প্রজাপতির ডানা, কবুতরের ডানা, কল্পনার ডানা : রং ঠোকরাতে থাকে ক্যানভাস থেকে আমার দিকে, বদ্ধ জানালা এবং দরজার দিকে রং ভেঙে ফেলবে সব কিছু চিৎকার করে করে, একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট ভবিষ্যৎ তৈরি করে। বশীর ছবি আঁকতে আঁকতে বিপ্লবের কথা ভাবে, যে বিপ্লবের ভাবনা তার প্রথম যৌবনের দিনগুলোকে কল্পনার ডানায় মুড়ে দিয়েছে। বশীর প্রায়ই বলে : বিপ্লবের কথা ভাবি ইতিহাসের ভালগারিটি থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য। পেইন্টিং এবং ড্রইং সে করেছে ইতিহাস তৈরি করতে চেয়েছে বলে। ইতিহাস তৈরি করার অর্থ, পাকিস্তানের প্রথম দিকে ক্ষমতার ওপর হাত রাখা (সে সময় আমিনুল কিংবা বশীর ইতিহাসের ওপর হাত রেখে কাজ করেছে, যেমন আমরা লেখকরা : হাসান কিংবা আমি, তাই করেছি)। এই ক্ষমতা, মুসলিম লীগের অন্ধকার ভেদ করার দিক থেকে জরুরি ছিল। আমরা এভাবে ইতিহাস সহ্য করেছি, অহংকারদীপ্ত হয়ে, এই অহংকার একদিকে যেমন জরুরি, তেমনি অন্যদিকে অপ্রতিরোধ্য। এই সহ্য করার ক্ষমতা, আমাদের বাঙালিদের, বিশেষভাবে ছিল। এই ছিল আমাদের বিশেষ ঐতিহাসিক আইন, যে আইন আমরা ইনহেরিট করেছি লেনিন এবং ট্রটস্কি থেকে, সূর্য সেন এবং ইলা মিত্র থেকে (ইলা মিত্রের ওপর বশীরের একটা বিখ্যাত গল্প আছে : কয়েকটি কমলালেবু)। ইতিহাসের এই আইন, আমরা পেইন্টাররা এবং রাইটাররা দু'হাতে বুক ঢেকে কৃষক আন্দোলন এবং ভাষা আন্দোলন পেরিয়ে এসেছি। এই সহ্য করার ক্ষমতা থেকে অ্যাবসট্রাকশন তৈরি হয়েছে। অ্যাবসট্রাকশন তো রক্ত থেকে তৈরি হয় (বশীরের ভাষা আন্দোলনের ওপর কবিতা ও হাসানের ভাষা আন্দোলনের ওপর কবিতা, বশীরের ইলা মিত্রের ওপর স্কেচ ভোলা যায় না)। বশীরের কাজ প্রথম থেকেই দু'ধরনের : ফিগারেটিভ এবং নন-ফিগারেটিভ। ফিগারেটিভ কাজের কেন্দ্র : মানুষের মুখ, পুরুষ ও নারীর মুখ। নন-ফিগারেটিভ কাজের কেন্দ্র : রং, ছড়ানো রং : রঙের মধ্য দিয়ে একটা বক্তব্য তৈরি করা। তার বক্তব্যের ধরন : স্পষ্ট। দেয়াল কিংবা এপিটাফ কিংবা ডানা : তার বিভিন্ন বক্তব্য কিংবা একটি বক্তব্যের প্রসারণ। এ বক্তব্যটাই তার ফিগারেটিভ কাজে ঘুরে ঘুরে এসেছে। এ বুঝি তার বিখ্যাত ঐতিহাসিক নিয়ম, যে নিয়মটা সে খুঁজেছে তার নানা কাজে। এসব কাজ সেনসুয়াল : ফিগারেটিভ কিংবা নন-ফিগারেটিভ যাই হোক। বশীর সাড়া দেয় তার সব শক্তি নিয়ে। মুখ মানে বিষাদ, মুখ মানে বিষণ্নতা, মুখ মানে উজ্জ্বলতা। আবার রং মানে বিষাদ, রং মানে বিষণ্নতা, রং মানে উজ্জ্বলতা।
আমার মনে হয় বশীরের কাজ খুব টেন্ডার। টেন্ডারনেস ধরার চেষ্টা তার ফিগারেটিভ কাজে, তেমনি নন-ফিগারেটিভ কাজে। বশীর তা এঁকে চলেছে প্রথম থেকে। তার মধ্যে তার নিজের জন্য কোনো করুণা নেই। করুণা ছাড়া টেন্ডারনেস বশীর খুঁজে বেড়াচ্ছে। এখানেই তার সাহস। তার কাজ সিনথেটিক, পেইন্টিংগুলো চোখ থেকে এবং স্মৃতি থেকে তৈরি করা। তার ফিগারেটিভ কাজগুলো নির্দিষ্ট মুখ, নির্দিষ্ট চেহারা, নির্দিষ্ট স্মৃতি রিপ্রেজেন্ট করে। অন্যদিকে তার নন-ফিগারেটিভ কাজ : দেয়াল সিরিজ আমাদের দমবন্ধ করা ঢাকা শহরের কথা মনে করায় কিংবা এপিটাফ সিরিজ মৃত্যুমুখী ঢাকা শহরের নৈরাজ্য আমাদের ঘিরে ধরে, কিংবা ডানা সিরিজ একটা সবুজ মাঠের তৃষ্ণা মনে জাগায়। বশীরের যেসব কাজ আমার সংগ্রহে আছে (প্রথম পর্যায়ের এবং মধ্য পর্যায়ের), সেসব এবং কেয়া গ্যালারিতে প্রদর্শিত আপাতত শেষ পর্যায়ের কাজ আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমাদের বন্ধুত্ব, একসঙ্গে বেড়ে ওঠা, একসঙ্গে পৃথিবীকে চ্যালেঞ্জ করা। ইতিহাসের বিভিন্ন মুহূর্তের মধ্যে বশীর ও আমি একসঙ্গে বেঁচে আছি। এই বেঁচে থাকার জীবন্ত পোট্র্রেট তার বিভিন্ন কাজ।
=============================
খবর- চলন্ত ট্রেনের নিচে মেয়েকে নিয়ে মা'য়ের আত্মহত্যা  গল্প- 'সেদিন অফিসে যায়নি আন্দালিব' by হাবিব আনিসুর রহমান  বিজ্ঞান আলোচনা- মানবযকৃৎ উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীরা সফল  খবর- দিলমা রুসেফ । নারী গেরিলা থেকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট  আলোচনা- 'সকল গৃহ হারালো যার' by তসলিমা নাসরিন  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিষয় কাশ্মীর-ইনসাফ ও স্বাধীনতা by অরুন্ধতী রায়  ইতিহাস- 'ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ডায়েরি' by শাহাদুজ্জামান  বিজ্ঞান আলোচনা- নাসা আজীবনের জন্য মঙ্গলে মানুষ পাঠাবে  ফিচার- ‘বাইশ্যা নাচ' by মৃত্যুঞ্জয় রায়  আদিবাসী আলোচনা- 'বেদিয়া নাকি সাঁওতাল' by সালেক খোকন  আলোচনা- 'পর্যটন ও জীববৈচিত্র্য:প্রেক্ষাপট-বাংলাদেশ হেমায়েত উদ্দীন তালুকদার  খবর- নাগোয়া সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ঐতিহাসিক চুক্তি  খবর- ছয় দশক পর দুই কোরিয়ার স্বজনদের পুনর্মিলন


কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে। শিলালিপি থেকে
লেখকঃ বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.