দলীয় পরিচয়ে নিয়োগ অনৈতিক ও ক্ষতিকর by আবদুল লতিফ মন্ডল

ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম তাদের বলেছেন, রাজনীতি করার কারণে তোমাদের সময় কম, আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে তাই আমাদের উচিত ছাত্রলীগের পাশে দাঁড়ানো। তাই তোমরা বিভিন্ন চাকরির লিখিত পরীক্ষা একটু ভালো করে দাও, বাকিটা আমরা দেখব। গত ১২ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) মিলনায়তনে ৩রা নভেম্বর জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে ছাত্রলীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। এইচটি ইমাম আরও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা তোমাদের সঙ্গে আগেও ছিলাম, এখনও আছি। এখনও প্রধানমন্ত্রীর কাছে যখনই কারও বায়োডাটা নিয়ে যাই, তখনই তিনি জিজ্ঞেস করেন, সে কি ছাত্রলীগ করেছে? কোথায় করেছে? কোন পদে ছিল? তোমাদের চাকরি দিতে প্রধানমন্ত্রী ও আমি কম চেষ্টা করি না।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে দলীয় পরিচয়ে কাউকে সরকারি চাকরিতে (সরকারি চাকরি বলতে স্বশাসিত, আধা-স্বশাসিত সংস্থা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিকেও বোঝাবে) নিয়োগে সহায়তা প্রদানের আশ্বাস বা প্রতিশ্র“তি দেশের প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধান অনুযায়ী, বিশেষ বিধান প্রণয়নের মাধ্যমে নাগরিকদের কোনো অনগ্রসর অংশের প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ, কোনো ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে ওই ধর্মাবলম্বী বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ অথবা কোনো কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তা নারী বা পুরুষের জন্য সংরক্ষণ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে এবং নিয়োগ হবে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে।
স্বাধীনতার পরপরই দলীয় বিবেচনায় সরকারি চাকরিতে লোক নিয়োগ দেয়া শুরু হলেও তা ছিল সীমিত। ১৯৯১-২০০৬ সময়কালে দেশের দুটি বড় দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পালাক্রমে দেশ শাসনের দায়িত্বে থাকাকালে দলীয় বিবেচনায় সরকারি চাকরিতে লোক নিয়োগের প্রসার ঘটতে থাকে। ২০০৭-২০০৮ সময়কালে নির্দলীয় সরকারের আমলে এ অনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ থাকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং বর্তমানে তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ক্ষমতাসীন দলের লোক না হলে অথবা ক্ষমতাসীন দলের কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তির সক্রিয় সহযোগিতা না পেলে অথবা মোটা অংকের ঘুষ না দিলে যে সরকারি চাকরি হতে পারে, জনগণ তা বিশ্বাস করতেই ভুলে গেছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শাসনামলে (২০০১-২০০৬) অভিযোগ ছিল যে, বিসিএস ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সুপারিশ সংবলিত তালিকা পাবলিক সার্ভিস কমিশনে প্রেরণ করা হতো। ওই শাসনামলে (২০০৫ সালে) বিএনপির অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ১৫০ জনকে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ প্রদান মুখরোচক আলোচনায় পরিণত হয়েছিল। এ রকম আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিগত মহাজোট সরকার এবং বর্তমান সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থীদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রদান অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। মহাজোট সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ডা. মোদাচ্ছের আলী ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, দেশের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোয় সৃষ্ট বিভিন্ন ক্যাটাগরির ১৩৫০০টি পদ শুধু আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের প্রার্থীদের দিয়েই পূরণ করা হবে। তার এই ঘোষণায় জনগণ বিস্মিত হয়েছিলেন। ওই আমলে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও নির্বাচনে জয়ী রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেছিলেন, দল আমাকে নির্বাচিত করেছে, মেয়র হিসেবে দলের লোকদের নিয়োগ তো দেবই। তিনি আরও বলেছিলেন, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তিনি তার দলের লোকদের নিয়োগ দিয়েছেন এবং তাদের অনেককে স্থায়ীও করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান উপদেষ্টা এইচটি ইমাম কোনো রকম রাখঢাক না করে ১২ নভেম্বর ছাত্রলীগের প্রার্থীদের চাকরি প্রদানে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের জড়িত থাকার কথা প্রকাশ করে দিয়েছেন। ১৭ নভেম্বর ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এইচটি ইমাম অবশ্য দাবি করেছেন, ১২ নভেম্বর ছাত্রলীগের উদ্দেশে দেয়া তার বক্তব্য গণমাধ্যমে বিকৃত ও খণ্ডিতভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। এইচটি ইমামের এ দাবি কতটা সত্য, গণমাধ্যম তার জবাব দেবে বলে আশা করা যায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, দলীয় পরিচয়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ অনৈতিক ও প্রশাসনের জন্য ক্ষতিকর কেন?
এক. ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থা আমরা পেয়েছি উত্তরাধিকার সূত্রে। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে এ শাসনব্যবস্থার নীতি হল, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগদান। আরেকটি নিয়ম হল, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে নিয়োজিত ব্যক্তিদের চাকরিতে বহালের কোনো সম্পর্ক না থাকা এবং তাদের দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের, বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মকাণ্ডের সুফল বিভিন্ন মতাবলম্বী মানুষের কাছে পৌঁছাতে নিরপেক্ষ প্রশাসনের বিকল্প নেই।
কেউ কেউ যোগ্যতার প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠে দলীয় পরিচয়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সমর্থনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্পয়েলস সিস্টেমের (spoils system) উদাহরণ টানেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্পয়েলস সিস্টেমের সীমিত প্রচলন আছে। এ পদ্ধতির সারবত্তা হল, ক্ষমতা লাভকারী রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের যোগ্যতা বিচার না করে পুরস্কারস্বরূপ সরকারি চাকরি প্রদান। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সপ্তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্র– জ্যাকসনের সময় (১৮২৯-৩৪) এ পদ্ধতি চালু হয়। সরকারি চাকরিতে মেধা ও যোগ্যতা অবহেলিত হওয়ায় স্পয়েলস সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। এর ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে মেধা মূল্যায়নের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সুপারিশ প্রদানের জন্য আইন পাসের মাধ্যমে সিভিল সার্ভিস কমিশন গঠন করা হয়। স্পয়েলস সিস্টেম বর্তমানে মূলত ফেডারেল সরকারের উচ্চ পদগুলোতে নিয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
দুই. উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ না করে দলীয় পরিচয়ে নিয়োগ প্রদান অনৈতিক। কারণ এতে যেসব মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন অর্থাৎ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তারা চাকরি থেকে বঞ্চিত হন। এর ফলে অনৈতিক কাজ স্বীকৃতি পায়, যা সমাজে নানা অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
তিন. মেধাবী ও যোগ্য লোক চাকরি না পেলে রাষ্ট্র তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। এতে রাষ্ট্রের সব স্তরে অদক্ষতা ও স্থবিরতা দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমরের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, আলোচ্য উপদেষ্টা ছাত্রলীগের সভায় বেপরোয়াভাবে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে যে কথা বলেছেন তা হল- লিখিত পরীক্ষায় যদি তারা পাস করে তাহলে মৌখিক পরীক্ষায় তাদের কোনো অসুবিধায় পড়তে হবে না। সরকার তাদের চাকরির ব্যবস্থা করবে। অর্থাৎ তারা ছাড়া অন্য কারও পক্ষে সরকারি চাকরিতে ঢোকা প্রায় অসম্ভব। এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে, ছাত্রলীগের এ নেতাকর্মীরা মেধাশূন্য। সর্বত্র যেভাবে কারচুপি চলছে তাতে লিখিত পরীক্ষায় পাস করাও তাদের পক্ষে কোনো অসুবিধার ব্যাপার বা কঠিন নয়। এভাবে লিখিত পরীক্ষায় পাস করে মৌখিক পরীক্ষায় সরকারের সহায়তা লাভ করে যারা চাকরিতে যোগদান করবে, প্রশাসন তারাই পরিচালনা করবে এবং এর ফলে প্রশাসন হবে মেধাশূন্য। ক্ষমতা ও মেধাশূন্যতা যে দুর্নীতির জনক হবে এটা স্বাভাবিক। (যুগান্তর, ১৬ নভেম্বর)।
চার. গণতন্ত্রের অগ্রগতির জন্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন পরিচালনা করেন। নির্বাচন পরিচালনা করতে গিয়ে তাদের নানা রকম চাপের সম্মুখীন হতে হয়। দক্ষ ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের পক্ষেই এসব নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব। ১৯৯১-২০০৮ সময়কালে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তাদের ভূমিকা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। উপদেষ্টা এইচটি ইমামের বক্তব্যে একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক দলীয় স্বার্থে প্রশাসনকে ব্যবহারের যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা সরকারি কর্মকর্তাদের অর্জিত সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গণতন্ত্রের অগ্রগতি।
সবশেষে যা বলা দরকার তা হল, মার্কিন ইতিহাস প্রমাণ করে যে, জনগণ রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্রে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেধাবী ও যোগ্য লোক নিয়োগের পরিবর্তে কোনোভাবেই দলীয় পরিচয়ে লোক নিয়োগ পছন্দ করে না। দেশের ক্ষমতাসীন সরকার এবং ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতাসীন হবে, তারা এ সত্যটি যত শিগগির উপলব্ধি করবে, ততই মঙ্গল।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.