পাকিস্তানে বইছে রক্তের স্রোত

এক মেয়ে নিখোঁজ। আরেক মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে
পরিবারের সম্মান রক্ষার নামে। দুই মেয়ের ছবি
হাতে মা রাজিয়া শেখ। ছবি: এএফপি
আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন রাজিয়া শেখ। চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছে বুক। কোলে পবিত্র কোরআন শরিফ। মহান আল্লাহর কাছে বিচার চাইছেন তিনি। রাজিয়ার এক মেয়ে এখন নিখোঁজ, আরেক মেয়েকে পরিবারের সম্মান রক্ষার অজুহাতে হত্যা (অনার কিলিং) করেছে প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মীয়রা। বিধবা রাজিয়ার বয়স চল্লিশের কোঠায়। মেয়েদের প্রসঙ্গ তুলে বিলাপ করতে করতেই দুজনের দুটি ছবি দেখালেন তিনি। একটি ছবি বড় মেয়ে খালিদার, অন্য ছবিটি ছোট মেয়ে সাহিদার; প্রাণহীন, সাদা কাফনে মোড়ানো। পাকিস্তানে রাজিয়ার মতো এমন কষ্টের মুখোমুখি হওয়া মায়ের সংখ্যা অনেক। পরিবারের সম্মান রক্ষার অজুহাতে বা আত্মীয়দের প্রতিহিংসায় যাঁদের সন্তান খুন হয়েছে। পাকিস্তানে নারীদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করা সংগঠন দ্য আওরাত ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০০৮ সাল থেকে পরিবারের সম্মান রক্ষার অজুহাতে দেশটিতে তিন হাজারেরও বেশি নারীকে হত্যা করা হয়েছে।
শুধু পরিবারের অমতে বিয়ে করা বা কাউকে ভালোবাসার জন্যই নয়, সম্পত্তির ভাগ থেকে নারীদের বঞ্চিত করার মতলবে হত্যার ক্ষেত্রে অজুহাত হিসেবে তোলা হয় পরিবারের সম্মান রক্ষার বিষয়টি। পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে সিন্ধু নদের তীরে সাচাল শাহ মিয়ানি গ্রামে একটি ঘর নিয়েই রাজিয়ার বাড়ি। তিনি জানালেন, ২০১০ সালে করাচিতে তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে নিখোঁজ হন বড় মেয়ে খালিদা। সেই মেয়ে কোথায়, কীভাবে আছে জানেন না তিনি। কিন্তু খালিদা নিখোঁজ হওয়ার দায় রাজিয়ার কাঁধে চাপানো হলো। একপর্যায়ে ওই বাড়ির লোকজন তাঁর ছোট মেয়ে সাহিদাকে ওই পরিবারের এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে বলে। রাজিয়া এতে রাজি হননি। তাঁর এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয় ওই পরিবারের লোকজন। হঠাৎ একদিন তিনজন লোক এসে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করে সাহিদাকে। এই হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করতে সাহিদার বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অভিযোগ তোলা হলো। বলা হলো, পরিবারের মানসম্মান রক্ষার জন্য সাহিদাকে হত্যা করা হয়েছে। ওই হত্যাকারীদের বিচার হয়নি। কাঁদতে কাঁদতে রাজিয়া বলেন, ‘মহান আল্লাহর কসম দিয়ে আমি মন্ত্রী,
বিচারপতি ও পুলিশের কাছে ন্যায়বিচারের আবেদন জানাচ্ছি।’ এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরকার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তেমন সফলতা মিলছে না। অভাবী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্মান রক্ষার নামে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চলছেই। ওই অঞ্চলগুলোতে পরিবারের সুনাম রক্ষার বিষয়কে খুব বড় করে দেখা হয়। আবার পাকিস্তানের আইনে ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে হত্যাকারীকে ‘মাফ’ করে দিতে পারেন হত্যার শিকার ব্যক্তির স্বজনেরা। যার মানে দাঁড়ায়, স্বজনেরাই কাউকে হত্যা করলে তার শাস্তি এড়ানোও সম্ভব। পাকিস্তানে চাচাতো, মামাতো, ফুফাতো, খালাতো ভাইবোনদের মধ্যে বিয়ে খুবই সাধারণ ব্যাপার। এসব বিয়ের পেছনে যৌতুকের মতলব জড়িত। সম্মান রক্ষার নামে হত্যাকাণ্ড বন্ধে সিন্ধুর প্রাদেশিক সরকার ২০০৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখা খোলে। এই শাখার প্রধানও করা হয় একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তাকে। আইরুম আওয়ান নামের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘সম্মান রক্ষার অজুহাতে যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে, তার বেশির ভাগই বোন বা কন্যাকে সম্পত্তির ভাগ না দেওয়ার উদ্দেশ্য থেকে ঘটানো হচ্ছে।’ অভিযোগ আছে, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা কিংবা প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ার কারণে এ ধরনের হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। সূত্র: এএফপি।

No comments

Powered by Blogger.