পুলিশে ফিট, বিআরটিএ-তে আনফিট!

ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে পরিচালিত বিআরটিএর অভিযানে গত এক সপ্তাহে রাজধানীতে দেড় শতাধিক মামলা হয়েছে। বিভিন্ন অপরাধের দায়ে জরিমানা আদায় হয়েছে লক্ষাধিক টাকা। এসব মামলায় সংশ্লিষ্টদের অনেকে এর আগেও ট্রাফিক পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন। তখন রফা হওয়ায় তারা নির্ভয়ে রাস্তায় গাড়ি হাঁকিয়েছেন। কিন্তু  পুলিশের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়া এসব ‘ফিট গাড়ি’ এবারের অভিযানে ধরা পড়ল আনফিট হিসেবে। সাম্প্রতিক বড় কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনার পর ফিটনেসবিহীন যানবাহন, লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তার মন্ত্রণালয় থেকে গত ২৮ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয়। এরপর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব জেলায় একযোগে অভিযান শুরু হয়। অভিযানে ফিটনেসবিহীন বিভিন্ন যানবাহন জব্দ এবং চালকদের জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তিও দিচ্ছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। বাস-মিনিবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেলসহ ব্যক্তিগত যানবাহন আটকে এসবের ফিটনেস, রঙ, রুট পারমিট ও চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাতে যারা উতরাতে পারছে না তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা বা মামলা হচ্ছে। এদিকে, অভিযানের কারণে রাজধানীতে হঠাৎ কমে যায় গণপরিবহনের চলাচল। এতে ভোগান্তিতে পড়ে যাত্রীরা। ভুক্তভোগী যাত্রীদের মন্তব্য- মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে অভিযানের কারণে সময়মতো গন্তব্যে যেতে পারছেন না তারা। প্রতিদিন বিআরটিএর তিনটি এবং ডিসি অফিসের একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। সাধারণত একেক সময় একেক স্থানে অভিযান চলে। তবে এবার  ঘোষণা দিয়ে সারা দেশে একযোগে অভিযান শুরু করায় এবং কড়াকড়ি করায় যাত্রীদের দুর্ভোগ বেড়েছে। বিআরটিএর সহকারী পরিচালক ইমাম হায়দার নতুন বার্তা ডটকমকে জানান, রাজধানীতে গত এক সপ্তাহের (মঙ্গল থেকে বৃহস্পতি এবং রবি ও সোমবার) অভিযানে, ১৫১টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বিভিন্ন অপরাধে এক লাখ ২১ হাজার ৯০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মতো বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্টরাও নিয়মিত রাস্তায় চলা গাড়িগুলোর কাগজপত্র যাচাই করেন। তার পরও ফিটনেসবিহীন গাড়ি কীভাবে চলছে? বিআরটিএর ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক সমরেশ কুমার বিশ্বাস নতুন বার্তা ডটকমকে বলেন, “ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্টরা সারা বছর ধরপাকড় করেন। কিন্তু তারা প্রকৃতই কাজ করলে এসব গাড়ি কি রাস্তায় চলতে পারে? তারা অনেক শক্ত। তাদের বিষয়ে কে বলবে? কিছু বলা যায় না। বিআরটিএর যে জনবল আছে, তা দিয়ে আমরা মানুষকে সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি।” ভ্রাম্যমাণ আদালতে মামলা হয়েছে, মিরপুর-মতিঝিল রুটে চলাচলকারী এমন একটি গাড়ির চালক সাইফুল ইসলাম। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, তার গাড়ির ফিটনেস সমস্যা কিছুটা থাকলেও রাস্তায় চলতে পারে। তবুও ট্রাফিক পুলিশ ধরলে ২০০-৩০০ টাকা দিলে ছেড়ে দেয়। কিন্তু বিআরটিএর গত সপ্তাহের অভিযানে তার গাড়ির ফিটনেস সমস্যার কারণে দুই হাজার টাকা জরিমানা হয়। মোহাম্মদপুর-বনশ্রী রুটে চলাচলকারী আরেকটি বাসের চালক শিপন মিয়া বলেন, “গাড়ির কাগজপত্র ঠিক রাখার দায়িত্ব মালিকের। অনেক সময় তাদের গাফিলতির কারণে ট্রাফিক পুলিশ আটকালে আমাদের ঝামেলায় পড়তে হয়। ট্রাফিক পুলিশ ধরলে শ খানেক টাকা ধরিয়ে দিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ থাকলেও বিআরটিএর অভিযানে ১৫০০ টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছে। ঘুষের অভিযোগ অস্বীকার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের (দক্ষিণ) উপকমিশনার খান মোহাম্মদ রেজওয়ান নতুন বার্তা ডটকমকে বলেন, “ফিটনেস সার্টিফিকেট না থাকলে আমরা রেকারিং করি। কিন্তু এক হাজার গাড়ি তো ডাম্পিংয়ে ফেলে রাখা যাবে না।” মোহাম্মদ রেজওয়ান  বলেন, “ডাম্পিংয়ে ফেলে রেখে জাতীয় সম্পদ নষ্ট করার অধিকার কারো নেই। এ জন্য আমরা ফিটনেসবিহীন গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঁচ-সাত দিন আটক রেখে মালিকদের চাপ দেই, যেন তারা ফিটনেসের জন্য ব্যাংকে টাকা জমা করে। কোনো ক্ষেত্রে ১৫ দিনের মধ্যে ফিটনেস ওকে করার শর্তে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়।” এ ছাড়া কোনো পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এসব কাজে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কোনো গণপরিবহনকে রাস্তায় চলাচলের জন্য বিবেচিত হতে হলে অন্তত ৩০ ধরনের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সামান্য সংখ্যক যানই এসব পরীক্ষা উতরাতে পারে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার রাস্তায় চলাচলরত বেশির ভাগ বাসই ২০ বছরের পুরোনো। এসব বাস কালো ধোঁয়া নির্গমন করে, ব্রেকও থাকে ত্রুটিপূর্ণ, অবৈধ হাইড্রলিক হর্ন ও যথাযথ রিয়ার ভিউ মিরর ও সিগন্যাল বাতির অভাবে এগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তার ওপর বাস, মিনিবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বেশির ভাগ যানবাহনের নেই বৈধ লাইসেন্স। ফিটনেস পরীক্ষায়ও রয়েছে ফাঁকি। আছে ঘুষ নিয়ে লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন অবৈধ যানকে অবাধে চলাচল করতে দেয়ার অভিযোগ। এমনকি কোনো কোনো মালিক তাদের অবৈধ যানবাহনের চলাচলের রুটে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ফাঁড়িগুলোতে মাসিক হারে চাঁদা দিয়ে থাকেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.