র‌্যাব-১১ সদস্যরা বহাল থাকায় প্রশ্ন হাইকোর্টের

নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনার পরও র‌্যাব-১১ সদস্যরা বহাল থাকায় এবং একেক জনকে একেক দিন জিজ্ঞাসাবাদ করায় প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, আমরা পত্রপত্রিকায় দেখেছি, র‌্যাব ১১-এর সব সদস্যই ঘটনার পর কর্মরত ছিলেন। নারায়ণগঞ্জে র‌্যাবের একটি ইউনিট ছিল। তাদের সবার নাম, ঠিকানা, পদবি ছিল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা তো কঠিন কাজ নয়। একেক সময় একেক জনকে এনে জবানবন্দি নেয়া হচ্ছে। কাউকে একদিন পর, কাউকে সাতদিন পর, কাউকে দশদিন পর নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অথচ সবাই চাকরিতে বহাল রয়েছেন। তাদেরকে জড়ানোর জন্য নাকি অংশ বিশেষকে রক্ষার জন্য এটা করা হচ্ছে? সাত খুনের ঘটনায় মঙ্গলবার হাইকোর্টে পৃথক তিনটি অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। পুলিশের মহাপরিদর্শক, র‌্যাব ও সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি থেকে পাঠানো এসব অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোমতাজ উদ্দিন ফকির। বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের দিন ধার্য করেছেন ১০ ডিসেম্বর।
আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, র‌্যাব-১১ সদস্যদের গ্রেফতার করতে, গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সমস্যা কোথায়? এভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা নিয়ে যাতে জনমনে কোনো প্রশ্ন না উঠে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
অনুসন্ধান থেকে অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) বাদ দেয়া প্রসঙ্গে হাইকোর্ট বলেন, আপনারা তো সিআইডির বিষয়টি নিয়ে আপিল বিভাগে গিয়েছেন। আপিল বিভাগ সিআইডিকে বাদ দিয়েছেন। মনে রাখবেন, আদালতের হাত ছোট নয়। আদালত নিয়মিত তদন্তেও হস্তক্ষেপ করতে পারেন। আপিল বিভাগের কাজ আপিল বিভাগ করেছেন। হাইকোর্টের কাজ হাইকোর্ট করবেন। পুলিশের আইজির পাঠানো প্রতিবেদন আদালতে তুলে ধরে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, ‘সাক্ষীদের যথাযথ নিরাপত্তা দেয়ার নির্দেশ ছিল। সেটি প্রতিপালন করা হয়েছে’। এ সময় আদালত বলেন, ‘কোথায়? সাক্ষীরা তো হুমকির মুখে রয়েছে। সে কথা তো বললেন না। আইজির প্রতিবেদনেই হুমকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে’। তখন মোমতাজ উদ্দিন ফকির প্রতিবেদন থেকে সংশ্লিষ্ট অংশ পড়ে শোনান।
র‌্যাবের প্রতিবেদন তুলে ধরে মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, র‌্যাব এ পর্যন্ত ৮৭ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এসব জবানবন্দি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করতে এক সপ্তাহ সময় লাগবে।
সাত সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন তুলে ধরে রাষ্ট্রপক্ষের এই আইন কর্মকর্তা বলেন, তারা চার সপ্তাহের সময় চেয়েছেন। এই কমিটি র‌্যাব-১১ এর তিন কর্মকর্তা, নূর হোসেনের দেহরক্ষী, নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র আইভী ও সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ ৩৭৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে র‌্যাবের কেউ কেউ কারাবন্দি রয়েছেন। যাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে, তাদের সাক্ষ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ থেকে ঘটনার মোটামুটি ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়েছে। আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী গ্রেফতার হয়নি। ভারতে আটক নূর হোসেনের সাক্ষ্য গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে তার সাক্ষ্য নেয়া হবে। র‌্যাবের আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। এসব কারণে আরও চার সপ্তাহ সময় লাগবে।
তিন প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর আদালত সিআইডির বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক আপিল বিভাগে নেয়া প্রসঙ্গে কথা বলেন। পরে আদালত বলেন, আপিল বিভাগ বলেছেন, সিআইডি অনুসন্ধান করতে পারবে না। বাকিগুলোর অনুসন্ধান চলবে। এর অর্থ নিয়মিত তদন্তের পাশাপাশি অন্য অনুসন্ধানও চলতে পারে এবং সেসব তদন্তের সাক্ষ্যমূল্য আছে।
এরপর আদালত বলেন, ‘আগামী ১০ ডিসেম্বর আদেশ দেব’। এ পর্যায়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম নাজমুল হক বলেন, ‘পক্ষগুলো কি ওই তারিখে আবার প্রতিবেদন দাখিল করবে?’ আদালত বলেন, প্রয়োজন নেই। র‌্যাব কি এই সময়ের মধ্যে তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেবে কিনা। জবাবে আদালত বলেন, আগে করতে তো অসুবিধা নাই। আমরা শুধু আদেশের জন্য তারিখ নির্ধারণ করলাম, আপিল বিভাগের আদেশ দেখে সিদ্ধান্ত নেব পরবর্তী কী আদেশ দেব।
উল্লেখ্য, হাইকোর্টের সুয়োমটো (স্বতঃপ্রণোদিত) আদেশে চাঞ্চল্যকর এই খুনের ঘটনার তদন্ত শুরু করে ডিটেক্টটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) ও সিআইডি। পরে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এই ঘটনার তদন্ত থেকে সিআইডিকে বাদ দেয়ার দাবি ওঠে। যুক্তি দেখানো হয়, ফৌজদারি মামলার তদন্ত দুটি সংস্থার মাধ্যমে করা আইনগতভাবে সঠিক নয়।
গত ১০ জুলাই হাইকোর্ট সিআইডিকে তদন্ত থেকে বাদ দিতে রাষ্ট্রপক্ষের লিখিত আবেদন খারিজ করে আগের আদেশ কিছুটা সংশোধন করে দেন। নতুন আদেশে সিআইডিকে ইনভেস্টিগেশনের (তদন্তের) পরিবর্তে ইনকোয়ারি (অনুসন্ধান) করতে বলা হয়। সিআইডির ইনকোয়ারি নিয়েও আপত্তি তোলে রাষ্ট্রপক্ষ। এ ঘটনা থেকে পুরোপুরি দূরে রাখতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন জানায়। গত ১২ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের ওই আবেদন মঞ্জুর করে সিআইডিকে এ ঘটনার অনুসন্ধান থেকে বাদ দেন আপিল বিভাগ।
গত ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজন অপহরণের শিকার হন। এরপর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৩০ এপ্রিল ছয়জনের এবং পরদিন ১ মে আরেকজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী একটি মামলা করেন। নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে র‌্যাবের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ করেন। পরে এক স্বতঃপ্রণোদিত আদেশে ৫ মে হাইকোর্টের উপরোক্ত বেঞ্চ সিআইডিকেও এই তদন্তের দায়িত্ব দেয়।

No comments

Powered by Blogger.