আত্মসমালোচনায় বিএনপি হার্ডলাইনে সরকার by সাজেদুল হক

রাজনীতির মাঠে দৃশ্যত কোন পরিবর্তন নেই। কঠোর অবস্থানে সরকার। রাজধানীতে সভা-সমাবেশের মতো মামুলি কর্মসূচিও করতে দেয়া হচ্ছে না। মাঝে সরকারের ভেতরে মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে কিছু কথাবার্তা হলেও এখন তা মিলিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক চাপ কমে আসার প্রেক্ষাপটে অন্তত ২০১৯ সাল পর্যন্ত তেমন কোন সমস্যা দেখছেন না সরকারের নীতিনির্ধারকরা। যদিও তাদের পাখির চোখ আরও অনেক দূরে। অন্যদিকে, শেষ পর্যন্ত আত্মসমালোচনা শুরু হয়েছে বিএনপিতে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পরপর আন্দোলন কর্মসূচি থেকে সরে যাওয়া ভুল ছিল বলে এখন উপলব্ধি করছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দলীয় নেতাদের সঙ্গে সর্বশেষ দু’-তিনটি বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্যদেরও সমালোচনা করেন তিনি। ঘোষণা দিয়েছেন নেতারা না থাকলে কর্মীদের নিয়ে একাই মাঠে থাকার। তবে বিএনপি তার আন্দোলন কৌশলের অতীতের ভুল কতটা পর্যালোচনা করছে তা স্পষ্ট নয়। ২৯শে ডিসেম্বরের মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি প্রোগামে দলীয় নেতারা কেন বের হননি সে রহস্য আজও পুরোপুরি খোলাসা নয়। সরকারের পক্ষ থেকে ম্যানেজ আর চাপের কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল। কাউকে কাউকে মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে পরিণতির কথা স্মরণ করে দেয়া হয়েছিল। অন্যদিকে, কাউকে কাউকে করা হয়েছিল ম্যানেজ। সহিংসতার আর কম ভোটার উপস্থিতির মাধ্যমে সম্পন্ন জানুয়ারির নির্বাচন আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তবে আন্তর্জাতিক দুনিয়া একই সঙ্গে সহিংসতার সমালোচনাও মুখর ছিল। ঘরে-বাইরে চাপের মুখে হতচকিত হয়ে পড়ে বিএনপি। আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। যদিও বিএনপির একটি অংশ সে সময় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিল। বিএনপিতে দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত নেতা সে সময় ঢাকার নেতাদের বলেছিলেন, একবার আন্দোলন বন্ধ করে দিলে কর্মীদের আর বাঁচানো সম্ভব হবে না। তাদের পরবর্তী সময়ে আন্দোলনেও পাওয়া যাবে না। তবে সরকারের কড়া হুঁশিয়ারি আর আন্তর্জাতিক দুনিয়ার আশ্বাসের প্রেক্ষাপটে বিএনপি সে সময় আকস্মিকভাবে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। তারপর থেকেই আন্দোলনের প্রস্তুতির কথা বলছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ছাত্রদলে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। যদিও এ কমিটি দলের ভেতরেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। ছাত্রদলে বিদ্রোহ দমাতে বিএনপির হাইকমান্ডকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঢাকা মহানগরে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি। তবে দলীয় প্রধানের অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার বিভিন্ন থানা ও ওয়ার্ড কমিটি গঠনের কাজে গতি বেড়েছে। তবে বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক কৌশল নিয়েও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। তারা স্মরণ করেছেন, স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কথা। রাজধানীর আশপাশে সীমাবদ্ধ সে আন্দোলনে এরশাদের পতন হয়েছিল। যদিও সেনাবাহিনীর সমর্থন প্রত্যাহার তার পতনের ক্ষেত্রে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। ক্ষয়ক্ষতি এবং কঠোরতার দিক থেকে জানুয়ারির নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ের মতো আন্দোলন বাংলাদেশে অতীতে হয়নি বলে অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করেন। ঢাকায় ওই আন্দোলনের ঢেউ লাগেনি। বিএনপি নেতৃত্ব ঢাকায় আন্দোলনের ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন। যদিও ঢাকায় ব্যর্থতা মানে শুধু ঢাকা মহানগর কমিটির ব্যর্থতা নয়, কেন্দ্রীয় নেতাদেরও ব্যর্থতা। এ নেতাদের কোন ধরনের জবাবদিহি করতে হয়নি। অথচ যে তৃণমূল আন্দোলনে সফলতা দেখায় সে তৃণমূলে কমিটি পুনর্গঠনের তোড়জোড় চলে। বেগম খালেদা জিয়াও আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে বিভিন্ন জেলা সফর করছেন। বিএনপি কবে আন্দোলনে নামবে তাও এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। যদিও একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করবে দলটি। এক্ষেত্রে সরকার বিরোধী সব দল ও সংগঠনগুলোকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা থাকবে। বিদেশী শক্তির সমর্থন বৃদ্ধির চেষ্টাও চালাচ্ছে বিএনপি। ওদিকে, বিএনপি যখন এখনও ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টায় রত তখন সরকার আরও হার্ডলাইনে যাওয়ার ইংগিত দিচ্ছে। সাংগঠনিকভাবে দল গোছানোর বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। সহযোগী সংগঠনগুলোকেও একই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বাড়িয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রেও সরকার এখন অন্য সময়ের চেয়ে নিজেদের অবস্থান শক্ত মনে করছে। কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশন (সিপিএ) এবং ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নে (আইপিইউ) জয়কে সরকার নিজেদের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন হিসেবে দেখছে। রোববার সংসদে দেয়া বক্তব্যে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত দশম জাতীয় সংসদ নিয়ে সমালোচনাকারীদের অর্বাচীন হিসেবে আখ্যায়িত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সিপিএ এবং আইপিইউতে নির্বাচিতদের ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি একথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যারা নানা কথা বলেছেন, নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে যারা কথা বলেছেন, আজকে সারা বিশ্ব কিন্তু এর জবাবটা দিয়ে দিয়েছে দুই নির্বাচনের মাধ্যমে। এরপরও যারা কথা বলবেন বা বলছেন; আমি মনে করি আসলে তারা অর্বাচীন। গণতন্ত্র সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই।’ কিছু কিছু অভ্যন্তরীণ ঘটনায় সরকার সাময়িক বিপাকে পড়লেও ভারত এখনও পাশে থাকায় পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করার ব্যাপারে ক্রমেই আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এক্ষেত্রে বিরোধীদের প্রতি আরও কঠোর আচরণের ইঙ্গিত মিলছে। নাগরিক সমাজও গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের ওপর চাপ বাড়ছে। নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত দ্যা ক্যাপিটাল এক্সপ্রেসের সম্পাদক বি জেড খসরু মনে করেন, ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন থাকার কারণে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে যাবেন যতক্ষণ না অভ্যন্তরীণভাবে তাকে বড় কোন আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হয়।

No comments

Powered by Blogger.