বরিশালে রেজিস্ট্রি অফিসে তুঘলকি কারবার

খবর পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ফোনে জানানো হয়েছিল তাকে। অনুরোধ করা হয়েছিল বেআইনি কাজটি না করতে। তবু সব কথা উপেক্ষা করে একই জমির বিপরীতে আরও একটি বায়না চুক্তি রেজিস্ট্রেশন করলেন তিনি। আগে করা এ সংক্রান্ত চুক্তির মেয়াদ বহাল থাকা অবস্থায়। খুব সহজেই প্রশ্ন উঠেছে, কেন এটি করলেন তিনি? কোন বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে এভাবে একটি বেআইনি বায়না চুক্তি করলেন বরিশাল সদর উপজেলার সাবরেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিক?
যে জমি নিয়ে এ ঘটনা ঘটেছে তার বর্তমান বাজার দর প্রায় ১৫ কোটি টাকা। তাছাড়া এই জমি নিয়ে ইতিপূর্বেও ঘটেছে নানা ঘটনা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, একটি বায়না চুক্তি বহাল থাকা অবস্থায় নতুন করে জমিটি কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ান। বায়না বাবদ ইতিমধ্যে বেশ কয়েক লাখ টাকা জমির মালিককে দিয়েছেনও তিনি।
বরিশাল নগরীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিএন্ডবি রোড এলাকায় এ জমি অবস্থিত। যার মোট আয়তন প্রায় ৬৪ শতাংশ। সরকার নির্ধারিত রেটে এর দাম ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা দেখানো হলেও চলতি বাজার দর হিসেবে এর দাম দাঁড়ায় প্রায় ১৫ কোটি টাকা। সৈয়দ সাবের হোসেন নামে এক প্রবাসী এই জমির মালিক। বরিশাল নগরীর বিভিন্ন এলাকায় আরও বেশ কিছু জমি রয়েছে ওই ব্যক্তির। এসব জমি কেনা-বেচার নাম করে বিভিন্ন সময়ে নানা অঘটন ঘটানোরও রেকর্ড রয়েছে তার বিরুদ্ধে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নিজের ছবি আর ভাইয়ের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে জমির বিপরীতে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেয়া। আইনগতভাবে শাস্তিমূলক এ কাজটি তিনি করেছেন চলতি বছরের ৫ মার্চ। পরে অবশ্য বিষয়টি ধরা পড়লে আবার সাবরেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে ওই পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বাতিল করেন তিনি। আলোচিত এই ব্যক্তি চলতি বছরের ২৪ আগস্ট তার মালিকানাধীন সিএন্ডবি সড়কসংলগ্ন প্রায় ৬৪ শতাংশ জমি বিক্রির উদ্দেশে বায়না চুক্তি করেন কামরুল হাসান এবং মো. আলতাফ হোসেনের সঙ্গে। বরিশাল সদর উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের নথিপত্র অনুযায়ী, ৩ লাখ টাকা নগদ প্রাপ্তির বিনিময়ে ওই চুক্তি করেন তিনি।
বায়না চুক্তিমূলে আলোচ্য জমির ক্রেতা কামরুল আহসান জানান, এরপরও বিভিন্ন সময়ে আরও ৭ লাখ টাকা নিয়েছেন সাবের হোসেন। কিন্তু জমি বুঝিয়ে দেননি। উপরন্তু ১৭ নভেম্বর হঠাৎ শুনতে পাই যে, আমাদের সঙ্গে করা বায়না চুক্তি বহাল থাকা অবস্থায় তিনি মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ানের সঙ্গে একই জমি বিক্রির আরেকটি বায়না চুক্তি করছেন। তাৎক্ষণিকভাবে আমরা যোগাযোগ করি সদর সাবরেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিকের সঙ্গে। সবকিছু জানানো সত্ত্বেও তিনি আমাদের উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে আরেকটি বায়না চুক্তির রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করে দেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সদর সাবরেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিক বলেন, বায়না চুক্তি করার সময় এরকম একটি ফোন আমার কাছে এসেছিল। আমি তাদের বলেছিলাম প্রমাণাদি নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে। এরপর এক ঘণ্টা অপেক্ষা করলেও তারা কেউ আসেনি। পরে আমি বায়না চুক্তি রেজিস্ট্রি করি। যেখানে একটি অভিযোগ উঠল সেখানে বিষয়টি যাচাই-বাছাই না করে কিভাবে এটি করলেন? তাছাড়া আপনার দফতরেই তো যাচাই-বাছাইয়ের ব্যবস্থা ছিল। সেক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না করে সময় নিয়েও তো কাজটা করতে পারতেন, এমন প্রশ্নের অবশ্য কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি সাবরেজিস্ট্রার।
এদিকে তার দফতরের একাধিক সূত্র জানায়, মোটা অংকের টাকার বিনিময়েই হয়তো এই বেআইনি কাজটি করেছেন তিনি। যদিও বিষয়টি স্বীকার করেননি আবু বকর। তাকে ভুল বুঝিয়ে সাবের হোসেন ওই বায়না চুক্তি রেজিস্ট্রি করিয়ে নিয়েছেন বলে দাবি তার।
একটি বায়না চুক্তি বহাল থাকতে প্রায় ১৫ কোটি টাকা মূল্যের জমি কিনতে আরেকটি বায়না চুক্তি কেন করলেন জানতে চাইলে মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ান যুগান্তরকে বলেন, সাবের হোসেন জমি বিক্রি করবেন শুনে আমি তার সঙ্গে বায়না চুক্তি করেছি। এর আগে ওই জমির আর কোনো বায়না চুক্তি আছে কিনা তা আমার জানা নেই।
সৈয়দ সাবের হোসেন বলেন, কামরুল-আলতাফ আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। বায়না চুক্তিতে লেখা পুরো টাকা তারা আমাকে দেয়নি। তাছাড়া দ্বিতীয়বার বায়না চুক্তি করার আগে পূর্বের চুক্তি বাতিল করতে আমি পরপর তিনবার তাদের নোটিশ দিয়েছি। টাকা না পাওয়ার বিষয়ে থানায় জিডি করা হয়েছে। এক মাস সময় বাড়িয়েও তারা আমার সঙ্গে চূড়ান্ত দালিলিক কাজ করতে পারেনি। ফলে ওই চুক্তি বাতিল করি আমি। প্রথম চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২য় বায়না চুক্তি করা হয়েছে। বায়না চুক্তি বাতিল করতে হলে রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে করতে হয় তা করেছেন কিনা জানতে চাইলে অবশ্য তিনি না সূচক উত্তর দেন। এক পর্যায়ে তিনি ক্ষেপে গিয়ে বলেন, আমার জমি নিয়ে আমি যা খুশি তাই করব। আর আপনাদের যা খুশি আপনারা তা-ই পত্রিকায় লিখে দিন।

No comments

Powered by Blogger.