জীবন কথন- তিনটি বিষয় আমাকে বড় উত্ত্যক্ত করে by রণজিৎ বিশ্বাস

ঘরে কি আপনার অনেক যন্ত্রপাতি আছে? যেমন ধরুন, ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি? : অবশ্যই! আমার এত বছরের শ্রমজীবন, এত বছরের রোজগেরে জীবন, আমার এত বছরের সঞ্চয়ের জীবন অনেক যন্ত্রপাতি থাকবার কথা নয় কি আমার!
: কী কী আছে?


: আপনারও জানবার দরকার নেই, আমারও বলবার ইচ্ছে নেই। তবে, একজন মানুষের রাজার হালে চলার জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সবই আছে। আমার শৈশবে কৈশোরে তারুণ্যে কল্পনাও করিনি যে এসব আমার থাকবে। তাছাড়া, ‘রাজার হালে চলা’র একটা ব্যাখ্যা থাকা দরকার। নইলে মানুষ তার বোঝার ক্ষমতা, আগ্রহ, আনন্দ, অন্তরলিপি ও রুচি-অভিরুচির সঙ্গে মিলিয়ে একেক ধরনের ব্যাখ্যা করে বসবে। রাজার হালে থাকা, রাজশয্যায় শোয়া ও রাজভোগ খাওয়া এগুলো সব আপনার ভাববার ব্যাপার। আপনার অন্তরের স্বরলিপির ব্যাপার। মহারাজার স্টাইলে জীবনযাপনের পরও আপনি ভাবতে পারেনÑ সংসারে আপনার মতো দুঃখী আর কেউ নেই। আবার আপনি তার উল্টোটাও ভাবতে পারেন। ভাবনাটা আপনার ব্যাপার; মানুষের ভাবনার ওপর কেউ কোন ট্যাকসো বসাতে পারে না।
একটা এগজাম্পল নিন। মহাধনাঢ্য এক ব্যক্তির বাড়িতে তার দু’জন বন্ধু বেড়াতে গেলেন। বন্ধুর বৈষয়িক সাফল্য দেখলেন, ভালোমন্দ খেলেন ও তাকে আশিস জানিয়ে ফিরে এলেন।
এবার দু’বন্ধুর প্রতিক্রিয়া শুনুন। একজনের কথা হলোÑ ওর অতটা আছে, আমার কেন নেই। কবে আমি ওর সমান হবো। বিধাতার দুচোখের দৃষ্টি সমান নয় কেন।
দ্বিতীয় জনের ভাবনা হলোÑ কী আনন্দ। সংসারে কত কম জিনিস নিয়ে আমি কত আরামে আর তৃপ্তিতে পরিতৃপ্তিতে চলতে পারি। এখন আপনি কোন গ্রুপে থাকবেন, থেকে শান্তি কিংবা অশান্তি কুড়োবেনÑ সেটি আপনার ব্যাপার।
: কঠিন সমস্যায় ফেললেন। এই জটিল চিন্তায় আমি সময় হারাব না।
: সেটিও আপনার ব্যাপার।
: আমি বরং আপনার গৃহকোণের যন্ত্রপাতি, আরাম-আয়েশের উপকরণ-সরঞ্জাম ইত্যাদিতে ফিরে যাই।
: তথাস্তু। ফিরে যান।
: আপনার ঘরে কোন্ যন্ত্রটির ব্যবহার খুব বেশি হয়?
: আমার হাতে, না আমার ভরাপুরা সংসারে অন্যান্য সদস্যের হাতে?।
: আপনার হাতে।
: তা যদি বলেন, খুব ছোট একটি যন্ত্র। টিভি’র রিমোট কন্ট্রোল। আমার হাতে যন্ত্রটির ওপর খুব অত্যাচার হয়।
: ওটির ওপর আবার অত্যাচার হওয়ায় কী আছে।
: আছে। আমি তো মূলত খবর আর টকশোই শুনি, তখনই এটির ব্যবহার বেশি করতে হয়। যখন যখন কোন সত্যবিরোধী, অনাধুনিক, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, কুশিক্ষিত ও ছদ্মমৌলবাদী আদর্শের কথা বলে, শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে অকারণে উত্তেজনা ছড়ায় ও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাবার জন্য গলা বাড়ায়,আমি স্থির থাকতে পারি না। আমার বড় কষ্ট হয়। আমি বড় উপদ্রুত বোধ করি। ওদের স্তব্ধ করার জন্য, ওদের শাস্তি দেয়ার জন্য আমাকে খুব ঘন ঘন রিমোট কন্ট্রোলের বুতাম টিপতে হয়।
: কিন্তু, টকশো কী ক্ষতি করল?
: কোন ক্ষতি করেনি। অনুষ্ঠানগুলো ভাল। সেগুলোয় সমাজের অসঙ্গতি যেমন ধরা পড়ে, একই বিশেষজ্ঞের মুখে সকল বিষয়ে সকল জ্ঞানের কথাও শোনা যায়। অর্থনীতি, রাজনীতি, বাজেট, বৈদেশিক সম্পর্ক, পদ্মা সেতু, ব্ল্যাকবেঙ্গল গোট-এর মাংসের উপকারিতা ও রফতানি-সম্ভাবনা কচি আনারসপাতার সাদা অংশের ভেষজ গুণাগুণ ইত্যাদি বিষয় ছাড়াও সংসারে হেন বিষয় নেই যা নিয়ে আমরা আলোকিত ও আলোকন ক্লান্ত হতে পারি না। কারও কারও কাছে আবার ফাও হিসেবে পাওয়া যায় তিনটি জিনিস। সর্ববিদ্যাবিশারদদের এই তিনটি বিষয় আমাকে বড় উত্ত্যক্ত করে।
: বিষয় তিনটি কী কী?
: তিনটি বিষয়ই মি-প্রান্তিক। আঁতলামি, ভাঁড়ামি ও ভ-ামি।
লেখক : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.