নবায়নযোগ্য জ্বালানি- পরিবেশ রক্ষার নিশ্চয়তা কোথায়? by মুশফিকুর রহমান

জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নানাভাবে উত্সাহিত করা হচ্ছে। প্রধানত, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন হ্রাস ও পরিবেশের দূষণ সীমিত করার তাগিদে কয়লার ব্যবহার কমানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি যেমন-বায়োডিজেল, ইথানলের ব্যবহার বাড়িয়ে খনিজ তেলের ব্যবহার সংকোচন করার চেষ্টা চলছে। তা ছাড়া সূর্যের আলো, বাতাসের


শক্তি থেকে বিদ্যুত্ উত্পাদনের পরিমাণ বাড়ানোর উদ্যোগ জোরেশোরেই চলছে। এ জন্য নানামুখী নীতি সহায়তা ও আর্থিক ভর্তুকি দিয়ে উত্সাহ দেওয়া হচ্ছে। ভৌগোলিকভাবে অনুকূল অবস্থানে সমুদ্রের ঢেউয়ের শক্তি কাজে লাগিয়ে এবং ভূগর্ভের তপ্ত পাথরে কৃত্রিম উপায়ে পানি প্রবেশ করিয়ে তা থেকে উত্পাদিত বাষ্প দিয়ে বিদ্যুত্ উত্পাদনের কৌশলও আয়ত্তে এসেছে। নদীর প্রবাহে বাঁধ দিয়ে জলের শক্তিতে টারবাইন ঘোরানো এবং সেখান থেকে প্রচলিত জলবিদ্যুত্ উত্পাদনের প্রযুক্তি যথেষ্ট পুরোনো হলেও প্রধান নবায়নযোগ্য বিদ্যুত্ উত্পাদন কৌশল হিসেবে অনুকূল পরিবেশে এখনো বহাল। জলবিদ্যুত্ উত্পাদনে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরিত না হলেও পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বিপর্যয় ঘটানোর সামর্থ্যে তা বিশ্বব্যাপী সমালোচিত প্রযুক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী যে হয়ে ওঠেনি, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিশ্বজুড়ে ব্যবহূত প্রধান জ্বালানির অবস্থান সূচকের দিকে তাকালে। আগামী কয়েক দশকেও এই অবস্থার তেমন পরিবর্তন হবে না বলেই পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের মোট উত্পাদিত বিদ্যুত্শক্তির মাত্র ১৯.৫% এবং প্রাথমিক জ্বালানির মাত্র ১৩.১% জোগান আসে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উত্স থেকে। ২০১১ সালের শেষে পৃথিবীতে উত্পাদিত বিদ্যুত্শক্তির মাত্র ৬৭ গিগাওয়াট (১ গিগাওয়াট=১০০০ মেগাওয়াট) সূর্যের আলো থেকে এবং ২৩৮ গিগাওয়াট বায়ুচালিত টারবাইন দিয়ে উত্পাদন সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে ২০১০ সালে ১০০ বিলিয়ন লিটার বায়োফুয়েল (ইথানল, বায়োডিজেল) উত্পাদন হয়েছে, যা বিশ্বের পরিবহন জ্বালানির মাত্র ৩% জোগান দিয়েছে (ব্রাজিলে ২৩%, যুক্তরাষ্ট্রে ৪% এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে ৩%)। যুক্তরাষ্ট্রে জীবাশ্ম জ্বালানির সঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণ বায়োফুয়েল মিশিয়ে ব্যবহার উত্সাহিত করা হচ্ছে এবং ২০০৫ থেকে এই উদ্যোগকে আইনি কাঠামোর অধীনে আনা হয়েছে। যেহেতু শস্য, আখ, তেলবীজ থেকে বায়োফুয়েল তৈরি করা হয়, সুতরাং এর উত্স নবায়নযোগ্য এবং বায়োফুয়েল পোড়ালে তুলনামূলকভাবে কম গ্রিনহাউস গ্যাস (প্রধানত কার্বন ডাই-অক্সাইড) নিঃসরিত হয়। একইভাবে বায়োফুয়েল পোড়ালে জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় কম ভাসমান বস্তুকণা বাতাসে ছড়ায়। সে বিবেচনায় বায়োফুয়েলকে পরিবেশ নীতিনির্ধারকেরা নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম প্রধান সম্ভাবনাময় উত্স হিসেবে বিবেচনা করেন।
কিন্তু বায়োফুয়েলের উত্পাদন বাড়াতে কৃষি এবং খাদ্যের জোগান এখন মারাত্মক সংকটে পড়েছে। কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বছরে প্রয়োজনীয় ডিজেল তেল যদি বায়োডিজেল দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে বছরে উত্পাদিত মোট সয়াবিনের ৬০% বায়োডিজেল প্ল্যান্টে কাঁচামাল হিসেবে জোগান দিতে হবে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে উত্পাদিত ভুট্টার ৪০% বায়োফুয়েল উত্পাদনে ব্যবহূত হয়। আরও উদ্বেগজনক খবর হলো, বায়োফুয়েল উত্পাদনে যে পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানির শক্তি ব্যবহূত হয়, তা উত্পাদিত বায়োফুয়েল থেকে পাওয়া যায় না। এদিকে পরিবেশবান্ধব ‘বায়োফুয়েল’ উত্পাদনের উত্সাহে বিশ্বের ‘রেইন ফরেস্ট’ উজাড় করে বেশি বেশি আখ, সয়াবিন এবং ভুট্টাখেত তৈরির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
প্রলম্বিত খরা ও বৃষ্টিহীন তপ্ত আবহাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে ভুট্টা ও সয়াবিনের উত্পাদন এবার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে সে দেশের কৃষি বিভাগ আশঙ্কা প্রকাশ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে গমের উত্পাদনও ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। বৈরী আবহাওয়ায় রাশিয়ার গম উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখন বিশ্ববাজারে ভুট্টা ও সয়াবিনের মূল্য এক মাস আগের মূল্যের চেয়ে ৩০% বেশি। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বিশ্ববাজারে ভুট্টা ও সয়াবিনের বর্ধিত চাহিদা সৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রের বায়োফুয়েল উত্পাদনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। ভুট্টার ঘাটতি মেটাতে গম ও সয়াবিনের বাড়তি চাহিদা সেগুলোর মূল্যবৃদ্ধি ঘটাতে ইন্ধন দিচ্ছে। ফলে বিশ্বে খাদ্যশস্য আমদানিকারক দেশগুলো বিশেষত, ভুট্টা, সয়াবিন এবং গম আমদানিকারক দেশগুলোতে উদ্বেগ বাড়ছে।
এদিকে গরিব সাধারণ মানুষের খাদ্য বা ক্যালরির জোগান যে শস্য এবং তেলবীজ থেকে প্রধানত পাওয়া যায়, বিত্তবানদের গাড়ির ‘পরিবেশবান্ধব জ্বালানি তেল’ উত্পাদনে তার ব্যবহার কতটুকু নৈতিক, সে প্রশ্নও আলোচিত হচ্ছে। তা ছাড়া ভুট্টা ও সয়াবিনের মূল্যবৃদ্ধি পশু ও পোলট্রি খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হবে। ফলে সাধারণ মানুষের জন্য মাংস, দুধ, ডিমসহ প্রোটিন দুর্লভ হবে। বিশ্বব্যাংকের এক গোপনীয় জরিপ প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ গার্ডিয়ান পত্রিকা জানিয়েছে, ২০০৮ সালে বায়োফুয়েল উত্পাদনের কারণে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের ৭৫% মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। ব্রিটিশ এক অনুরূপ গবেষণায় বায়োফুয়েলের কারণে খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির তথ্য পাওয়া যায় (ব্রিটেনে ডিজেলের সঙ্গে ২.৫% বায়োডিজেল মেশানো হয়)। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২০ সাল নাগাদ জ্বালানি তেলে ১০% পর্যন্ত বায়োফুয়েল মিশিয়ে ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে আগ্রহী। সে ক্ষেত্রে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য তা বড় ইন্ধন হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বায়োফুয়েল উত্পাদন বিশ্বের খাদ্যপণ্যের বাজারব্যবস্থাকে তিনভাবে প্রভাবিত করছে। প্রথমত, খাদ্যশস্য জ্বালানি তেল উত্পাদনে ব্যাপকভাবে ধাবিত হচ্ছে; কৃষক তাঁর ফসলি জমির উল্লেখযোগ্য অংশ বায়োফুয়েলের উপযোগী শস্যের জন্য বরাদ্দ রাখছে, ফলে ফসলের বৈচিত্র্য কমছে। বায়োফুয়েলের জন্য শস্যবাজারে মূল্যের অস্থিরতা ও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বাড়ছে।
সব মিলিয়ে এখন স্পষ্ট, সস্তায় জ্বালানি তেল পাওয়ার সময় ফুরিয়েছে। বিকল্প এবং পরিবেশসম্মত জ্বালানি তেল উত্পাদন পরিবেশের স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয়, কিন্তু খাদ্যশস্যকে সে কাজে ব্যবহার কতটুকু যৌক্তিক, তা ভাবার বিষয়। মাথাপ্রতি জ্বালানি ব্যবহার কত যৌক্তিকভাবে সংকুচিত করা যায়, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার প্রসঙ্গ। যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপ্রতি জ্বালানির ব্যবহারকে অন্যদের আদর্শসূচক হিসেবে না নিলেও পৃথিবীর উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে না। বরং জ্বালানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তি ও জীবনাচারই পরিবেশভাবনার চালিকাশক্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।
মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী এবং জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।

No comments

Powered by Blogger.