মধ্যপ্রাচ্য-সার্বভৌমত্বহীন গণতন্ত্র! by সেঁজুতি শুভ আহ্মেদ

সাধারণ লিবীয়দের রক্ষার ধুয়া তুলে পরাশক্তিকে গাদ্দাফি উচ্ছেদে যে বৈধ সার্টিফিকেট দেওয়া হলো, সেই সার্টিফিকেট লিবিয়াবাসীকে ঠেলে দিল দীর্ঘস্থায়ী মানবিক বিপর্যয়ের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যনীতির ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র কিংবা গণবিদ্রোহ_ এই তিন আদর্শের কোনটিকে কখন সমর্থন
করে কর্মপরিকল্পনা তৈরি হবে, তা নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রশক্তির অর্থনৈতিক-ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ বিশ্লেষণে। আরব বিশ্বে গণজাগরণের সাম্প্রতিক সুনামিতে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রশক্তি দ্বিমুখিতার ধারাবাহিকতায় হাজির হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের হস্তক্ষেপ নিয়ে।
নিরাপত্তা পরিষদের বিলম্বিত অনুমোদন ও লিবিয়ার আকাশে নো ফ্লাই জোন ঘোষণায় দীর্ঘসূত্রতার কারণ ছিল এরই ফাঁকে লিবিয়া আক্রমণের পূর্বপ্রস্তুতির সময় গ্রহণ। এতে লিবিয়া একটি 'দ্বিতীয় ইরাক' হতে যাচ্ছে। একটি তথ্য তুলে ধরলে ইতালি ও স্পেনের ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে লিবিয়ার ওপর ফরাসি হামলাকে বেগবান করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে পাঠকের সংশয় থাকবে না। তথ্যটি হলো, ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেনের ৮৫ শতাংশ তেলের জোগান আসে লিবিয়া থেকে। সুতরাং মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইরাক আগ্রাসনের মতো একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের মাধ্যমে প্রথমে লিবিয়াকে ধ্বংস, তাঁবেদার সরকার গঠন এবং এরপর তেল বিক্রির টাকায় লিবিয়া পুনর্গঠনের নামে লিবিয়ার তেলসম্পদের ওপর আগ্রাসী শক্তির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। প্রয়োজনে ঞড়ঃধষ, ঊহর, জবঢ়ংড়ষ-এর মতো আইওসির মাধ্যমে তেলসম্পদের হরিলুট। যে লিবিয়ায় তিউনিসিয়া বা মিসরের মতো স্বল্পকালীন বিদ্রোহের মাধ্যমে (যথাসময়ে অস্ত্র সাহায্য ও নো ফ্লাই জোন ঘোষণাসহ) সরকার পরিবর্তন করা যেত, সে লিবিয়াকে ঠেলে দেওয়া হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে।
সাধারণ লিবীয়দের রক্ষার ধুয়া তুলে পরাশক্তিকে গাদ্দাফি উচ্ছেদে যে বৈধ সার্টিফিকেট দেওয়া হলো, সেই সার্টিফিকেট লিবিয়াবাসীকে ঠেলে দিল দীর্ঘস্থায়ী মানবিক বিপর্যয়ের দিকে; গাদ্দাফিকে পতনের বিজয় যে বিপর্যয়ের কাছে ব্যাপকভাবে পরাজিত হবে। গাদ্দাফি নানা সময়ে আফ্রিকার বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে মদদ দিয়ে এসেছেন। আল কায়দার সঙ্গে গাদ্দাফির যোগ দেওয়ার হুশিয়ারি অনুযায়ী আজ সেই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো গাদ্দাফির সমর্থনে লিবিয়ায় ঢুকে পড়লে যুদ্ধ নতুন মোড় নেবে, লিবিয়া খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যেতে পারে। ভণ্ডুল হয়ে যাবে গাদ্দাফি পতনের নেপথ্যে বিদ্রোহীদের মহান উদ্দেশ্যগুলো। আরব বিশ্বের সাম্প্রতিক বিদ্রোহের স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এগুলো মূলত সামাজিক বিপ্লব। বিদ্রোহী সাধারণ জনগণ কোনো 'তন্ত্র'-এর মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের সূচনা করেনি। তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। স্বৈরাচারী শোষণ-বঞ্চনা, বেকারত্ব, মন্দা আর বাকস্বাধীনতাহীনতার কশাঘাতে আজ তারা রাজপথে নেমে এসেছে একটি জনকল্যাণকামী সরকার ব্যবস্থার অভীষ্ট লক্ষ্যে। কিন্তু বহুজাতিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ এই অর্থ বহন করে যে, 'ইঁদুর গর্ত খুঁড়ে মরে, সাপ এসে দখল করে।'
ইঙ্গ-মার্কিন চক্র গণঅভ্যুত্থানের অস্থিতিশীলতার সুযোগে, ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রের অজুহাতে (অস্ত্র রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে প্রথম) স্বৈরশাসন জিইয়ে রেখে কিংবা কখনও উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র রফতানির ধুয়া তুলে মধ্যপ্রাচ্য পেরিয়ে এখন উত্তর আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব তথা জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠনে হাত বাড়িয়েছে। আজ গাদ্দাফি ইউরোপীয় মিত্রদের বিরুদ্ধে বেইমানির অভিযোগ তুলেছেন। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাদশাহ আবদুল্লাহও মার্কিন মিত্রের বিরুদ্ধে বেইমানির অভিযোগ তুলবেন। সেদিন আর কিছুই করার থাকবে না। কেননা ততদিনে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবে 'উৎকৃষ্ট গণতন্ত্র'-এর প্রয়োজনীয়তা খুঁজে পাবে। এ গণতন্ত্রের মূল সূত্র যুদ্ধ-বাণিজ্যের প্রসার ও তেলসম্পদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।

সেঁজুতি শুভ আহ্মেদ :শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.