সংঘাত- আত্মঘাতী ছাত্ররাজনীতি আর কত দিন? by শেখ হাফিজুর রহমান

৮০ শতাংশের অধিক যুবক ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করেন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স স্টাডিজ ৬৫টি জেলায় ছয় হাজার ৫০০ যুবকের ওপর যে জরিপ করেছে, তার ফলাফল এটি। এঁদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ যুবক রাজনীতিতে তরুণদের সংশ্লিষ্ট করার বিপক্ষে।


৮০ শতাংশ যুবক হরতাল পছন্দ করেন না এবং অধিকাংশ যুবক সুস্থ-স্বাভাবিক রাজনীতির চর্চা দেখতে চান। রাজনীতির ধ্বংসাত্মক প্রবণতাগুলো নিয়ে যুবকদের দৃষ্টিভঙ্গি যথার্থ বলে মনে হয়। তবে বায়ান্ন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যে ছাত্ররাজনীতি আলোকবর্তিকা হয়ে জাতিকে পথ দেখিয়েছে, সেই ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে ৮০ শতাংশের বেশিসংখ্যক যুবক কেন বিরূপ ধারণা পোষণ করেন, তা বিবেচনার দাবি রাখে।
আমরা মনে করি, ছাত্রছাত্রীদের মূল কাজ হচ্ছে পড়াশোনা করা। পড়াশোনাটা ঠিকমতো না করলে রাজনীতি, অর্থনীতি বা দেশের উন্নয়নে তারা কী করে ভূমিকা রাখবে, তা বোধগম্য নয়। পড়াশোনাটা ঠিক রেখেই ছাত্রছাত্রীরা অন্যান্য কর্মকাণ্ড যেমন: বিতর্ক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদিতে অংশ নেবে। তারা অবশ্যই রাজনীতিসচেতন হবে, প্রয়োজনে রাজনীতিতে অংশও নেবে। তবে সেই রাজনীতি পড়াশোনা বাদ দিয়ে নয়, পড়াশোনা ঠিক রেখে। আর সেই রাজনীতি হবে ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের রাজনীতি, সেই রাজনীতি হবে শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নের রাজনীতি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যদি কোনো স্বৈরাচার স্থাণু হয়ে বসে, তার প্রতিবাদে শামিল হতে ছাত্রছাত্রীদের বাধা নেই। কিন্তু যে সর্বনাশা লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বাংলাদেশে চলছে, আমরা তার বিরোধী। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যাঁরা ছাত্ররাজনীতি করতেন, যাঁরা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদে নির্বাচিত হতেন, তাঁরা ছিলেন তাঁদের ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রী। নিয়মিত ক্লাস করে, পরীক্ষা দিয়ে, নানা বিষয়ের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে তাঁরা নিজেদের রাজনীতিসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট রাখতেন। কিন্তু এখনকার ছাত্রনেতা বা নেত্রীদের ক্লাস করতে হয় না, পড়াশোনা করতে হয় না, শুধু নেতা বা নেত্রীদের নামে ‘জিন্দাবাদ’ দিলেই হয়। এখনকার অধিকাংশ ছাত্রনেতা বা নেত্রী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানেন না, রাজনীতির ইতিবৃত্ত জানেন না, এমনকি তাঁরা যে মূল সংগঠনের অনুগামী, সেই সংগঠনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে যদি তাঁদের জিজ্ঞাসা করা হয়, তাঁরা তা বলতে পারবেন না। এখনকার ছাত্রনেতাদের দিনে-রাতে নেতা-নেত্রীদের নামে অনবরত ‘জিন্দাবাদ’ দিতে হয়। আর ‘জিন্দাবাদ’ দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চলে নির্মাণকাজের ঠিকাদারি বা ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন আদায় বা চাঁদাবাজি। ঠিকাদারি ও চাঁদাবাজি নিয়ে তৈরি হয় নানা দল ও উপদল, উপদলের কলহ কখনো কখনো সহিংস হয়ে ওঠে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি সহিংস হয়ে ওঠে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী এক মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে দেশ স্বাধীন হলো, সে দেশের সরকারি ছাত্রসংগঠনকে কেন ‘পাহারাদারের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে, বাম ছাত্রসংগঠনগুলোকে কেন ‘সাম্যবাদী সমাজ’ প্রতিষ্ঠার জন্য অস্ত্র হাতে সহিংস হতে হবে, তা বোধগম্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়ন ও সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার ডাকে বাম সংগঠনের ডাকে তখন হাজার হাজার মেধাবী তরুণ তাদের পতাকাতলে এককাট্টা হয়েছিল। উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব সত্ত্বেও আজ এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে হঠকারিতা ও নেতৃত্বের অবিমৃষ্যকারিতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাম রাজনীতি করতে এসে হাজার হাজার তরুণের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। ওই সময়ের ‘বিপ্লবী’ বাম রাজনীতিবিদদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী হয়ে বা ব্যবসা-বাণিজ্য করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন, কিন্তু তাঁদের ‘ছদ্ম’ ও ‘চতুর’ ‘বিপ্লবী বাণী’র আহ্বানে তারুণ্যের যে বিপুল অপচয় হয়েছে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ইতিহাসে তা এক বিয়োগান্ত ঘটনা।
১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতায় থিতু হয়ে বসলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। এরপর পরিস্থিতি হয়ে উঠল আরও ভয়াবহ। রাজনীতিকে কলুষিত করার জন্য তিনি যে ‘মিশন’ নিয়ে নেমেছিলেন, ছাত্ররাজনীতিও তার গ্রাস থেকে রেহাই পায়নি। ঠিক ওই সময় জিয়াউর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির ভয়াবহ এক হিংস্রতা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আবির্ভূত হয়। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ইসলামী ছাত্রশিবির ‘রগ কাটা ও গলা কাটা’ রাজনীতির সমার্থক হয়ে ওঠে। পুরো আশির দশক সারা দেশের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এত এত বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে, এত রক্তক্ষয় ও প্রাণহানি হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এত দিন অনির্ধারিত বন্ধ থেকেছে যে বাংলাদেশের শিক্ষার জন্য এটি একটি ভয়াবহ দশক বলে চিহ্নিত হবে।
নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা ছিল অনন্য। কেননা, ছাত্রছাত্রীদের শক্তিশালী আন্দোলন এবং শিক্ষকদের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে এরশাদের পতন ঘটে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যেই ছাত্ররাজনীতি তার নিজস্বতা বিসর্জন দিয়ে লেজুড়বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে। ছাত্র হত্যা, হল দখল, ক্যাম্পাস দখল, সেশনজট, বিলম্বিত শিক্ষাজীবন দেখে দেখে সাধারণ ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক ও সর্বস্তরের মানুষ ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে বিরূপ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন মহল থেকে ‘লেজুড়বৃত্তি’র ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দেওয়ার দাবি ওঠে। পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে উপদলীয় কোন্দলে একাধিক ছাত্র খুন হওয়ার কারণে বৃহত্ দুটি রাজনৈতিক দল তাদের ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করতে বাধ্য হয় কিংবা সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেয় ছাত্রসংগঠনের কর্মকাণ্ড। এর পরও লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি চলছে। এতে যে বৃহত্ দুটি রাজনৈতিক দলের খুব লাভ হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। কেননা, তারা যখন সরকারে থাকে, তখন তাদের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের হল দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, খুনোখুনি তাদের সম্পর্কে জনগণের মনকে বিষিয়ে তোলে। ওদিকে আন্দোলন-সংগ্রামের সময়ও ছাত্রসংগঠনের বলিষ্ঠ ভূমিকা দেখা যায় না। এ ধরনের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের কেন তাঁরা পোষেন, তা সত্যিই এক রহস্য! লেজুড়বৃত্তির এই ছাত্ররাজনীতির কারণে একদিকে তারুণ্যের বিপুল অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশ যত দ্রুত লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসবে, ততই মঙ্গল।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
hrkarzon@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.