রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ-সংলাপেই হোক সমস্যার সমাধান-

রমজান মাস ও ঈদ তুলনামূলক ভালোই কেটেছে। বিদ্যুৎ ও পানি নিয়ে হাহাকার ছিল না। বাজারে জিনিসপত্রের দাম এবং রাস্তাঘাটের অবস্থাও মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে ছিল। হরতাল কিংবা পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক কর্মসূচি, সংঘাত-সহিংসতাও ছিল না।


কিন্তু আসছে দিনগুলো কেমন যাবে? তা নিয়ে মানুষের মনে নানা সংশয় ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। কারণ প্রধান বিরোধী দল আগে থেকেই বলে আসছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ঈদের পর থেকে তারা কঠোর আন্দোলনে যাবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও অনড়। বাতিল করা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরবে না তারা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে এক বছর চার মাসের মতো। কোন সরকারের অধীনে সেই নির্বাচন হবে, সে বিষয়টি এখনো ফয়সালা না হওয়ায় আগামী নির্বাচন নিয়েও নানা ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে।
ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, তেমনি ভয় আমাদেরও হচ্ছে। ২০০৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। সে সময় বিচারপতিদের বয়স দুই বছর বাড়িয়ে একজন বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। বিরোধী দলগুলোর প্রবল আপত্তির কারণে তা করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই প্রধান উপদেষ্টা হন। নির্বাচন কমিশনকে বানানো হয় ঠুঁটো জগন্নাথ। আর তা নিয়ে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। দেশে রীতিমতো নৈরাজ্য তৈরি হয়েছিল। লগি-বৈঠা, লাঠি-বাঁশের রাজনীতি রাজপথ দখল করেছিল। বহু প্রাণহানি ঘটেছিল। অবশেষে দুই বছরমেয়াদি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছিল। আবারও কি আমরা তেমন কোনো পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছি?
বাংলা ভাষায় কাণ্ডজ্ঞান, বিচারবুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনাবোধ, মাত্রাজ্ঞান, পরিমিতিবোধ কিংবা এ ধরনের অনেক শব্দ আছে। কিন্তু হাল আমলে আমাদের রাজনীতি থেকে এ শব্দগুলো যেন নির্বাসিত হয়েছে। স্থান-কাল-পাত্রের যে পার্থক্যবোধ তা-ও যেন ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে সংসদই হওয়া উচিত রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু এ দেশে সংসদ ক্রমেই তার গুরুত্ব হারাচ্ছে। যখন কোনো দল ক্ষমতা হারিয়ে বিরোধী দলে যায়, তখন সে দল লাগাতার সংসদ বর্জন করে। কালেভদ্রে সেখানে গেলেও তখন যেসব আচরণ করা হয়, তাতে রাজনীতির যে লক্ষ্য, অর্থাৎ দেশ ও মানুষের কল্যাণ সাধন করা_তার বিন্দুমাত্র উপস্থিতিও দেখা যায় না। ফলে আমাদের দেশের রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা। কথায় বলে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। ক্ষমতার পালাবদলের এ লড়াইয়ে হরতাল আসে, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ হয়, নিরীহ বাসচালক বদর আলীর মতো অনেকেরই প্রাণ যায়। কিন্তু দেশের উন্নতি হয় না। দেশের মানুষের ভাগ্য ফেরে না।
আমাদের রাজনীতি যে কতটা অধঃপতনে গেছে, তা তো আমরা বছরের পর বছর দেখে আসছি। শুধু কলুষিত কথাবার্তা নয়, কলুষিত কাজকর্মও তো আমরা কম দেখিনি। জনসভায় বোমা হামলা, নির্বাচনের পর বিরোধীদলীয় কর্মীদের হয়রানি-নির্যাতন, দেশের সর্বনাশ করে নিজের আখের গোছানো_এসবই তো এখন হয়ে উঠেছে এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সেই রাজনীতির প্রয়োজনে কঠোর কর্মসূচি দিয়ে দেশকে আরো অস্থিতিশীল করাটা মোটেও কাম্য নয়। যেটা প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন করা, ব্যক্তিস্বার্থের বদলে দেশের স্বার্থে রাজনীতি করা। এ জন্য সংসদকে কার্যকর করতে হবে। কারণ সংসদ অকার্যকর করে সেই সংসদ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি থাকে না। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব ছাড়তে হবে। আলাপ-আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। এখানে কোনো পক্ষের আগ্রহের অভাব থাকলে দেশবাসীই তার মূল্যায়ন করবে। নির্বাচনের রায়েই তার প্রতিফলন ঘটবে।

No comments

Powered by Blogger.