২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে বিএনপি জড়িত ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জড়িত দাবি করে বলেছেন, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ ধরনের হামলা সম্ভব ছিল না। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালিয়েছিল।


তবে যারাই এটার সঙ্গে জড়িত, তাদেরই বিচার করা হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার এই বাংলার মাটিতে হবেই। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদমুক্ত দেশ গড়তে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব দল ও শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী জীবনে বার বার মৃত্যুর মুখোমুখি হলেও বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে চান বলেই তাঁকে বার বার হত্যার চেষ্টা করা হচ্ছে। জীবনে কয়েকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। একেকবার হত্যা চেষ্টা থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। মৃত্যুকে ভয় পাই না। বাংলাদেশ যেন অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক শক্তির হাতে আর না যায়, সেজন্য কাজ করে যাচ্ছি।
মঙ্গলবার ভয়াল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অষ্টম বার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আলোচনাসভায় সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে ওই হামলায় মৃত্যুজাল ছিন্ন করে প্রাণে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। গ্রেনেড হামলাসহ সব হত্যাকান্ডের বিচারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে তিনি আরও বলেন, জড়িতদের বিচার হবেই।
শোকাবহ পরিবেশে ও যথাযোগ্য মর্যাদায় বুধবার ঢাকাসহ সারাদেশে ২১ আগস্ট দিবস পালিত হয়। নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সর্বপ্রথম সকাল ১১টায় বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবং পরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে তিনি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সেখানে গ্রেনেড হামলায় নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে মোনাজাত হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা গোলাম সারোওয়ার মামুন। পরে নিহতদের পরিবারের সদস্যসহ আহতদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ও করেন প্রধানমন্ত্রী।
এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও মন্ত্রী পরিষদ সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন, বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মাহবুব-উল-আলম হানিফ, এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, ড. আবদুর রাজ্জাক, আকতারুজ্জামান প্রমুখ।
এ সময় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবর্গ, আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় ও উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য, সংসদ সদস্যবৃন্দ এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনসহ শ্রদ্ধা জানাতে আসা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন। সকালে প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের অস্থায়ী শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন ছাড়াও বিভিন্ন দল ও সংগঠন এই উপলক্ষে আলোচনাসভা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, আলোকচিত্র প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে দিবসটি পালন করে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কষ্টের তীব্রতা কমে যায়? হাত-পা, ক্ষত-বিক্ষত, জোড়াতালি দেয়া। এ যন্ত্রণা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বিচার পাইনি। এরপর আশায় ছিলাম, দল ক্ষমতায় আসবে, অপরাধীদের বিচার হবে। এখন দল ক্ষমতায়, আশাটা যেন পূরণ হয়। জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকলেও আমাদের একটাই দাবি- প্রকাশ্য দিবালোকে যারা এভাবে হত্যাযজ্ঞ চালালো সেই ঘাতকচক্র ও তাঁদের মদদদাতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হোক।
ভয়াল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় মৃত্যুজাল ছিন্ন করে প্রাণে বেঁচে যাওয়া পঙ্গুত্ববরণকারী বেশ ক’জন নারী নেত্রীর কন্ঠে ছিল এমনই দাবি। ঠিক ছয় বছর আগে যে স্থানটিতে ঘাতকরা মেতে উঠেছিল রক্তের হোলি খেলায়, বুধবার সেই স্থান বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মূল প্যান্ডেলে সারিবদ্ধভাবে টানানো ২১ আগস্টের সেই ভয়াল ও বীভৎস হত্যাযজ্ঞের আলোকচিত্র দেখতে গিয়ে শহীদদের পরিবার ও প্রাণে বেঁচে যাওয়া নেতাকর্মীদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ ছিল স্পষ্টই। ঘাতক গ্রেনেডের স্পিøন্টারের যন্ত্রণাদগ্ধ জীবনের কষ্ট আর প্রাণে বেঁচে যাওয়ার আনন্দ- এ দুই মিলিয়ে নিহতদের পরিবার ও আহতদের কান্না সেখানে সৃষ্টি হয়েছিল এক শোকাবহ পরিবেশ।
আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর হামলার পর আওয়ামী লীগ মুক্তাঙ্গনে প্রতিবাদ সমাবেশ করার পরিকল্পনা করলেও তৎকালীন জোট সরকার অনুমতি দেয়নি। শেষে রাতে অনুমতি দেয়া হয়। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কেন তা দেয়া হয়েছিল? আওয়ামী লীগ তো পরিকল্পনা বাদই দিয়েছিল।
তিনি বলেন, তাঁর (শেখ হাসিনা) বক্তৃতা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে একে একে ১৩টি গ্রেনেড ফাটানো হলো। যারা গ্রেনেড ছুড়েছিল তারা চলে গেলে যারা সেখানে হতাহতদের উদ্ধার কাজ চালাচ্ছিল, তাদের ওপরই পুলিশ টিয়ারগ্যাস ছুঁড়ল। লাঠিপেটা করল। এ ঘটনার বিচার যাতে না হয়, সেজন্য উদ্ধার করা অবি¯েম্ফারিত গ্রেনেডগুলোর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আলমতও নষ্ট করা হয়েছিল। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে এবং এর রায় কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। একইভাবে বাংলার মাটিতে ২১ আগস্ট হত্যাকান্ডের বিচারও অবশ্যই হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, যারা ভূমিদস্যুদের টাকায়, উলফার (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসম) পৃষ্ঠপোষকতায় মিডিয়া চালায়, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না, তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে গণতন্ত্র নস্যাত করতে। গণতন্ত্র নস্যাতের চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আলোচনাসভায় আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এবং সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ূয়া। সভা পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠান স্থল ত্যাগ করার পর পরই বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক দল ও সংগঠন অস্থায়ী বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। এসব দল ও সংগঠনের মধ্যে ছিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, সাম্যবাদী দল, বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুব মহিলা লীগ, ছাত্রলীগ, তাঁতী লীগ, মৎস্যজীবী লীগ, তরুণ লীগ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ, বাস্তুহারা লীগ, হকার্স লীগ, রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আইন পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাহিত্য পরিষদ, বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ, আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফোরাম, আওয়ামী শিশু-কিশোর যুব জোট, নারী মুক্তি আন্দোলন, মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড, তিতাস গ্যাস এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, ওয়াসা শ্রমিক ইউনিয়ন প্রভৃতি।

No comments

Powered by Blogger.