কণ্ঠস্বর-মধ্যপ্রাচ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে? by রাহাত খান

ইয়েমেন ও সিরিয়ায় নিকটভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা এতদিনে অনেকটাই পরিষ্কার। আরব বিশ্বের এ দুটি দেশেই সরকারবিরোধী গণতন্ত্রকামীরা ঐক্যবদ্ধ। নানা দল ও সংস্থা নিয়ে এ দুটি দেশে গড়ে উঠেছে একক প্লাটফর্ম। সমঝোতার প্রস্তাবে তারা নিজেদের দাবিনামাও পেশ করেছে


মধ্যপ্রাচ্য তেলসম্পদ এবং অন্যান্য কৌশলগত কারণে বিশ্বের পরা ও বৃহৎ শক্তিগুলোর কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়ে আসছে গত শতাব্দীর তিরিশ দশকের পর থেকেই। এই গুরুত্ব সময়ের ধারায় না কমে বরং বেড়েছে। হালে আরব বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে গণজাগরণ ও গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে। এক পক্ষে স্বৈরশাসক ও রাজতন্ত্র, অন্যদিকে অধিকারহারা শোষিত-বঞ্চিত সাধারণ মানুষ। ঘটনাক্রম এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, আরব বিশ্বে কোনো কোনো দেশে গৃহযুদ্ধের বিস্ফোরণ ঘটেছে। স্বাভাবিক কারণে পরা ও বৃহৎ শক্তির তো বটেই, বিশ্বের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিও মধ্যপ্রাচ্যের দিকে।
এই বিষয়টি নিয়েই আজ আলোচনা করার ইচ্ছা। তবে সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে বাদ দিয়ে পাশ কাটিয়ে অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া খুব মুশকিল। অন্তত আমার পক্ষে। আমি ক্রিকেটের কোনো খেলোয়াড় নই। কোনোদিন ছিলাম না। আমি বরাবর ছিলাম যাকে বলে খেলার দর্শক। তবে শুধু ক্রিকেটের সাদামাটা একজন দর্শক বললে বোধকরি সবটা বোঝায় না। গত দেড় মাস বিশ্বের অন্তত ৪০০ কোটি লোক বিশ্বকাপ ক্রিকেটের যে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল, আমি সেসব আক্রান্তের একজন। বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরু হওয়ার দিন থেকেই বাংলাদেশের প্রায় সবার মতো আমিও চেয়েছি বাংলাদেশ জিতুক। ইংল্যান্ডের মতো বড় দল এবং আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের মতো ক্রমেই শক্তিধর হয়ে ওঠা দলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয় যেমন আমাদের সবাইকে আনন্দে ভাসিয়ে দিয়েছে, তেমনি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের হেরে যাওয়া এবং কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে না পারাটাও তেমনি দুঃখ দিয়েছে বেশুমার।
ক্রিকেট বা ফুটবল বা যে কোনো খেলা হারজিতেরই খেলা। এ দুটি প্রধান খেলার জয়-পরাজয়ের সঙ্গে সমর্থকদের দুঃখ-আনন্দ মিলেমিশে আছে। এই যেমন বাংলাদেশের পর ক্রিকেটে যে দলকে সমর্থন করে আসছি বহুদিন ধরে, গত শনিবার ২ এপ্রিল, সেই দলের জয় এবং ক্রিকেটের বিশ্বকাপ ট্রফি লাভ করে ভারতের চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা আমাকে, আমার মতোই ভারতের সমর্থক আমার কিশোর বয়সী ছেলে ও স্ত্রীকে যে আনন্দ দিয়েছে, সেই আনন্দের বুঝি কোনো তুলনা হয় না। পাশাপাশি ফাইনাল খেলায় শ্রীলংকার পরাজয়ে গোটা শ্রীলংকাবাসী এবং ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান প্রভৃতি দলের সমর্থকদের মতো বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা শ্রীলংকার সমর্থকদের শোক ও হতাশাও যে কত মর্মবিদারী হয়েছে তা-ও কিছুটা অনুভব করতে পারি। তবে সে যা-ই হোক, বিশ্বকাপ ক্রিকেটের যবনিকাপাত হয়ে গেছে গত শনিবারেই, রাতের প্রথম প্রহরে। ক্রিকেট-জ্বরের মাত্রা এখন অনেকটাই নিচে। সংবাদপত্রে ক্রিকেট এখন সেরা সংবাদের স্পেস ছেড়ে দিয়ে ঢুকে গেছে ভেতরের খেলার পৃষ্ঠায় বা টুকিটাকিতে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় গত শনিবারের পর ক্রিকেট চলে গেছে সেরা সংবাদের তালিকা থেকে বড়জোর টক শোতে। ক্রিকেটের জন্য টিভি চ্যানেলের এই সামান্যটুকু আয়োজনও যে ক্ষণস্থায়ী হবে, হতে হতে শেষে শূন্যের কোঠায় চলে যাবে, সেটা প্রায় নিদ্বর্িধায় বলা যায়। তবে বিশ্ব টুর্নামেন্টের বাইরেও তো ক্রিকেট আছে। দেশে দেশে ক্রিকেট খেলা আছে। বলতে হয়, সারা বছরই ক্রিকেট খেলা চলে। প্রচারমাধ্যমেও তখন ক্রিকেট ফিরে আসে অনিবার্যভাবে আপন মহিমায়।
ক্রিকেটবোদ্ধা নই, তারপরও যে এতগুলো শব্দ, বাক্য খরচ করলাম ক্রিকেটের কথা বলতে গিয়ে, তার ভিন্নতর একটা কারণও রয়েছে। দেড় মাস ধরে চলা বিশ্বকাপ ক্রিকেট বিশ্বের বহু ঘটে যাওয়া কিংবা ঘটমান গুরুত্বপূর্ণ সংবাদকে কিছুটা হলেও অচল করে দিয়েছিল। অন্তত প্রচারমাধ্যমের লাইমলাইট পায়নি বিশ্বের নানা দেশে ঘটে যাওয়া বহু সেরা ও গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। ক্রিকেটের পাগল যে সাধারণ পাগলদের চেয়ে সংখ্যায় বহুগুণ বেশি, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
বেশি কথা না বাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আরব রাষ্ট্রগুলোর হালচাল নিয়ে বলি। মধ্যপ্রাচ্যের আরব বিশ্বে, গণতন্ত্র না হোক, দেশ শাসনের কিছুটা উদার পরিবেশ বিরাজ করছে বাহরাইন ও লেবাননে। বাহরাইন আমির (রাজা) শাসিত দেশ। আমির মরে গেলে বা কোনো কারণে সিংহাসন ত্যাগ করলে সেখানে সমাসীন হন আমিরের ছেলে বা আমিরের ভাই অথবা রাজবংশেরই অন্য কেউ। বাহরাইনে শিক্ষিতের হার শতকরা ৬০ ভাগের বেশি। মেয়েরা বেশিরভাগ অফিস-আদালত বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। তাদের যথেষ্টই ক্ষমতায়ন ঘটেছে, বলতে গেলে আরব বিশ্বের নিরিখে আশাতীত। আমিরশাসিত হলেও সেখানে পার্লামেন্ট আছে, মন্ত্রিসভায় নারী সদস্য রয়েছেন, মনোনীত ও নির্বাচিত লোকদের দিয়ে চলে পার্লামেন্ট। দেশ শাসনে পার্লামেন্টের মোটামুটি কার্যকর একটা ভূমিকা থাকে।
লেবাননে ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটে নির্বাচনী ধারায়। খ্রিস্টান ও মুসলিম অধিবাসীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকলেও, এমনকি কখনও-সখনও গৃহযুদ্ধ বাধলেও লেবাননই হচ্ছে আরব বিশ্বের একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ। লক্ষণীয়, বাহরাইনে সংস্কারের দাবিতে গণজাগরণ ঘটলেও আমির ও পার্লামেন্টের আশ্বাসে সে বিক্ষোভ এখন অনেকটাই প্রশমিত। তবে তিউনিসিয়া ও মিসরে গণজাগরণ অনেকটা সাফল্যের মুখ দেখলেও এবং এ দুটি দেশের রাজনীতি ঘটমান বর্তমানে স্থিতিশীল থাকলেও, অন্যান্য আরব দেশে, সৌদি আরব ছাড়া গণজাগরণ ও বিক্ষোভের আগুন জ্বলছেই। লিবিয়ায় তো গৃহযুদ্ধই চলছে। সিরিয়া এবং ইয়েমেনের পরিস্থিতিও বিস্ফোরণোন্মুখ। যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো মারাত্মক বিধ্বংসী ঘটনা ঘটে যেতে পারে একনায়কশাসিত এ দুুটি আরব দেশে।
লিবিয়া ও ইয়েমেনের প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। বলে নিই সিরিয়ার কথা। আরব বিশ্বে সিরিয়া গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বরাবরই এমনকি রাসূলুল্লাহর (সা.) আমলেরও আগে থেকে। সিরিয়ার ছিল সবসময়ই আরব রাজনীতির কেন্দ্র। এ দেশে এযাবৎকালে গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারেনি। খলিফা, রাজা এবং একনায়করাই আরব বিশ্বের এই গুরুত্বপূর্ণ দেশটি শাসন করে আসছেন। সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আসাদের আগে প্রেসিডেন্ট হিসেবেই দেশ শাসন করতেন তার বাবা জ্যেষ্ঠ আসাদ। পিতা ও পুত্রের মধ্যে মিল একটাই, তারা দু'জনই একনায়ক। দেশ শাসনের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী তারা। আর একটা মিল আছে। তারা দু'জনই আসাদ। পরপর মেয়াদে দেশের প্রেসিডেন্ট। তবে দুই আসাদ কিংবা বলা যায়, পিতা-পুত্রের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। জ্যেষ্ঠ আসাদ ছিলেন আরব জাতীয়তাবাদের কট্টর সমর্থক। আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধান নেতা মিসরের আততায়ীর হাতে শহাদাতবরণ করা প্রেসিডেন্ট নাসেরের ঘনিষ্ঠ বল্পুব্দ ছিলেন তিনি। জ্যেষ্ঠ আসাদ একনায়ক ছিলেন, তবে ইসরায়েলের প্রশ্নে ছিলেন আপসহীন। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি প্রশ্নে পশ্চিমা শক্তির ক্রীড়নক ছিলেন না কখনোই; বরং গোপনে তিনি নিজ দেশের সমরশক্তি এমন অত্যাধুনিক সমরসজ্জায় সজ্জিত করেছিলেন যে, আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইসরায়েল একমাত্র সমীহ করত সিরিয়াকে। পশ্চিমা শক্তি নানা কৌশলে ইসরায়েলি প্রশ্নে সিরিয়াকে নমনীয় ভূমিকা নিতে প্রলুব্ধ করেছে; কিন্তু কূটনীতি এবং দরকষাকষির আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ প্রেসিডেন্ট আসাদকে তার ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান থেকে একচুল নড়ানো সম্ভব হয়নি। দেশ শাসনেও কুশলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সিরিয়ায় তেলসম্পদ সামান্যই আছে। তবে সিরিয়ার ভেতর দিয়ে তেলের পাইপলাইন যেতে দিয়ে এবং সমুদ্র তীরবর্তী সমতল ভূমিতে কৃষি ও কৃষিনির্ভর খামার শিল্প গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিয়ে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আসাদ তার দেশের অর্থনীতিকে উৎপাদনশীল ও উজ্জীবিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তবে একটা দোষে তার সব গুণ ম্লান হয়ে যায়। সেটা হলো তিনি যে দেশ শাসনের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী একনায়ক ছিলেন শুধু তা-ই নয়, নিজের কর্তৃত্বের স্বার্থে দেশে জরুরি আইনও বহাল করেছিলেন। আর জনগণকে তাদের অধিকার দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।
এরপর একনায়করা যা করে, জ্যেষ্ঠ আসাদও তা-ই করেছিলেন। মরার আগে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে গিয়েছিলেন নিজ পুত্র জুনিয়র আসাদকে। বাপের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জুনিয়র আসাদ (বর্তমানে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ) একইভাবে দেশে জরুরি আইন বহাল রেখেছেন, ক্ষমতার কাছাকাছি যাতে কেউ আসতে না পারে সে জন্য নানা রকম নির্যাতনমূলক ও কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন। আর সিরিয়ার জনগণ? তারা তো কর্তৃত্ব বা দেশ শাসনের কোনো ফ্যাক্টরই নয়। তাদের অধিকার দেওয়া যে তাদের জন্মগত অধিকার_ বিষয়টির কানাকড়িও মূল্য নেই বর্তমান প্রেসিডেন্ট আসাদের কাছে; বরং হাজার দোষ থাকা সত্ত্বেও প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আসাদের ইসরায়েলবিরোধী যে ভূমিকা ছিল, সেই বীরোচিত ভূমিকা থেকে অনেকটাই সরে এসে তিনি গোপনে পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে দোস্তি পাতিয়েছেন, ইসরায়েল প্রশ্নে আপসের নীতি গ্রহণ করেছেন। জর্ডান, লেবানন, হালে গণঅভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া হোসনি মোবারক, মরক্কো, আলজেরিয়া, ইয়েমেন প্রভৃতি রাষ্ট্রের নেতাদের মতো জুনিয়র আসাদও গোপনে গোপনে একজন খেলোয়াড়_ সরাসরি ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে না গিয়েও স্বার্থের প্রশ্নে ইসরায়েলের পক্ষেরই একজন খেলোয়াড়। তিনি মনে করেন, এই গোপন আপসনীতিই আমৃত্যু একনায়ক প্রেসিডেন্ট থাকতে তাকে সাহায্য করবে।
বাপের মতোই তিনি জনগণের তোয়াক্কা করেন না। কিন্তু তিউনিসিয়া ও মিসরে গণসাফল্যের ঢেউ সিরিয়ায়ও এসে ভেঙে পড়েছে। সারাদেশে চলছে বিক্ষোভ। তাদের দাবি একনায়কতন্ত্রের অবসান। তাদের দাবি সংবিধানের গণতান্ত্রিক সংস্কার।
প্রথমদিকে গণবিক্ষোভকে তেমন গ্রাহ্য করেননি পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স হওয়া প্রেসিডেন্ট আসাদ। বোঝা গিয়েছিল, জনগণের এই দাবি শুনে এবং বিক্ষোভ দেখে বিরক্ত হয়েছিলেন। তার মতে, বেশ তো চলছে দেশ। এর মধ্যে আবার দাবি-দাওয়া কিসের? কেনই বা গণজাগরণ? বিরক্ত এবং অবশ্যই কিছুটা কাবু হয়ে 'লিখে নাও একফোঁটা দিলেম শিশির'-এর মতো করে, বলা যায় জনগণের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে দেশ থেকে পাঁচ দশক ধরে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা জরুরি আইন তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। তাতেও জনগণের জাগরণ ও বিক্ষোভ প্রশমিত না হয়ে বরং বেড়ে যাওয়ায় বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট। পরিবর্তনের আরেকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও নামকাওয়াস্তে করা মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলেন এবং পুরনো কৃষিমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন।
কিন্তু এসব পদক্ষেপ তো স্রেফ জনগণের চোখে ধুলা দেওয়া। জনগণ সেটা ঠিকই ধরতে পেরেছে। সিরিয়ায় গণতন্ত্রের দাবিতে জনগণের জাগরণ ও বিক্ষোভ বেড়েই চলেছে। ইতিহাস থেকে আমরা জানি, একনায়কের পতন জনগণের জাগরণ এবং বিক্ষোভ থেকেই হয়। প্রেসিডেন্ট আসাদের জন্য ইতিহাস ও ঘটমান বাস্তবতা নতুন কোনো নিয়ম-বিধি প্রবর্তন করবে না। পতন তার আসন্ন এবং অনিবার্য।
ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট সালেহ বহুদিন তার দেশের গণজাগরণ ও বিক্ষোভকে ধমক-ধামক, হুমকি, সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেওয়া ইত্যাদি করে ঠেকানোর চেষ্টা করে আসছেন। বিপ্লবের আগুন কিছুতেই থামে না এবং বাড়ছে তো বাড়ছেই দেখে অবস্থা বুঝে গোঁফ নামিয়েছেন এবং দেশের সর্বোচ্চ পদে ইস্তফা দিয়ে মানে মানে কী করে জানে রক্ষা পাওয়া যায়, সে জন্য আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। এখনও সে চেষ্টাই করছেন তিনি।
ইয়েমেন ও সিরিয়ায় নিকটভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা এতদিনে অনেকটাই পরিষ্কার। আরব বিশ্বের এ দুটি দেশেই সরকারবিরোধী গণতন্ত্রকামীরা ঐক্যবদ্ধ। নানা দল ও সংস্থা নিয়ে এ দুটি দেশে গড়ে উঠেছে একক প্লাটফর্ম। সমঝোতার প্রস্তাবে তারা নিজেদের দাবিনামাও পেশ করেছে। ইয়েমেন ও সিরিয়া_ এ দুই দেশেই গণতন্ত্রকামীদের এক নম্বর প্রস্তাব হচ্ছে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ। বলা যায়, ইয়েমেনের সালেহ এবং সিরিয়ার আসাদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। ক্ষমতা ছেড়ে তারা অসৎ উপায়ে অর্জিত শত শত কোটি ডলার নিয়ে কোথাও পালিয়ে যেতে পারেন কি-না কিংবা নির্বাসন ও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে পারেন কি-না, নাকি আত্মহত্যা করে সব সমস্যা ও বিপদ থেকে অব্যাহতি লাভ করবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়। জর্ডানে অবশ্য অবস্থা অতটা গুরুতর নয় এখনও। বাদশা আবদুল্লাহ গণতান্ত্রিক সংস্কারে রাজি আছেন এবং বাদশার আলঙ্কারিক পদ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন বলে সম্মত হওয়ায় জর্ডানে বিক্ষোভ এখনও ততটা বাঁধভাঙা হয়ে ওঠেনি। তবে স্বেচ্ছায় তো কেউ তার দেশ শাসনের সর্বময় কর্তৃত্ব সহজে ছাড়ে না। কাজেই দেখার বিষয়, নিকটভবিষ্যতে জর্ডানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়।
আরব বিশ্বে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে এখন তেলসমৃদ্ধ দেশ লিবিয়ায়। ৪২ বছর একনায়কতন্ত্রের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েও প্রথমে গণবিক্ষোভ, অধুনা যুদ্ধরত গণতন্ত্রকামীদের কাছে নতিস্বীকার করতে রাজি নন গাদ্দাফি। বঙ্গবল্পুব্দর আত্মস্বীকৃত খুনিদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছিলেন বিশ্ব-সন্ত্রাসের অন্যতম হোতা, নৃশংস চরিত্রের এই গাদ্দাফিই। শেয়ালের মতো ধূর্ত। মরুভূমির বিষধর সাপের মতো বিপজ্জনক। তিনি চেয়েছিলেন, তার পরে লিবিয়ার সর্বময় কর্তৃত্বের নেতা হবেন তার দ্বিতীয় পুত্র সাঈফ। কিন্তু প্রবল গণআন্দোলনের জোয়ারে আম ও ছালা দুই-ই ভেসে যাবে বুঝতে পেরে নৃশংস গাদ্দাফি এখন নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে সরকার অনুগত সেনা এবং ভাড়াটে সেনাবাহিনীকে হত্যাযজ্ঞ চালানোর হুকুম দিয়েছেন। এরই মধ্যে কয়েক হাজার গণতন্ত্রকামী এবং রাজনীতি না করা নিরীহ লোককে তার সেনাবাহিনী হত্যা করেছে। জাতিসংঘ লিবিয়ার এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার পর ন্যাটো বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমানের গোলাবর্ষণের ছত্রছায়ায় সরকারবিরোধীরা উত্তরের তেলসমৃদ্ধ এলাকার বেশ কয়েকটি শহর দখল করে নিয়েছিল। গাদ্দাফি বাহিনীও বেপরোয়া। তারা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ চলছে গুরুত্বপূর্ণ ব্রেগা, মিশরাতা, রাস-লানুক এবং আজদাবিয়া শহরে। যুদ্ধ একদিন না একদিন শেষ হবেই। গাদ্দাফির ভাগ্যও পশ্চিমা শক্তিগুলো (জার্মানি ও রাশিয়া ছাড়া) নির্ধারিত করে রেখেছে। ধনভাণ্ডার রেখে হয় কোনো দেশে আপসে গাদ্দাফির নির্বাসন, নতুবা বন্দিদশায় নৃশংস একনায়কের বিচার। মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলোয় গণঅভ্যুত্থানের জয় অবশ্যম্ভাবী, তাতে সন্দেহ নেই। তবে এরপর মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয় কি-না, সেটাই সময়ে দেখার বিষয়।

রাহাত খান : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.