বীর মুক্তিযোদ্ধা: তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪৮৯ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। জনাব আলী, বীর বিক্রম সাহসী এক যোদ্ধা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে জনাব আলীসহ এক দল মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান নেন মনতলায়। হবিগঞ্জ জেলার তেলিয়াপাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের হাতছাড়া হওয়ার পর মনতলা মুক্তিবাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়।


জুন মাসে ৩ নম্বর সেক্টরে বাংলাদেশের ভূমিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বশেষ অবস্থান ছিল মনতলা কমপ্লেক্সে। এর দক্ষিণে মোহাব্বতপুর, উত্তরে তেলিয়াপাড়া, পশ্চিমে মাধবপুর আর পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা।
তেলিয়াপাড়া দখল করার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী সর্বশক্তি নিয়োগ করে মনতলা দখলের জন্য। এখানে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি দল। আখাউড়া-সিলেট রেলপথের দুই ধারে তাঁরা মোতায়েন ছিলেন। জনাব আলীসহ মুক্তিযোদ্ধা দলের (কোম্পানি) অবস্থান ছিল মনতলা রেলস্টেশনে। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন এ এস এম নাসিম (বীর বিক্রম, পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও সেনাপ্রধান)। অপর দুই দলের একটি কাশিমপুর রেলস্টেশনে, আরেকটি হরষপুর রেলস্টেশন এলাকায় মোতায়েন ছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৫ জুন প্রথম দূরপাল্লার গোলাবর্ষণের মাধ্যমে জনাব আলীদের অবস্থানে আক্রমণের সূচনা করে। এরপর কয়েক দিন সেখানে যুদ্ধ হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়ন কৌশলে মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে এগিয়ে যায়। তারা দিনের বেলায় দূর থেকে হালকা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে গোলাগুলি করে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যস্ত রাখত। রাতে ভারী মেশিনগানের গুলি ও মর্টারের গোলাবর্ষণ করত। এর ছত্রচ্ছায়ায় তারা ক্রমে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের নিকটবর্তী হয়। মুক্তিযোদ্ধারা মাঝেমধ্যে এগিয়ে গিয়ে পাকিস্তানিদের বাধা দিতেন। কিন্তু এর মাধ্যমে তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রা ঠেকাতে পারেননি।
২০ জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী দল জনাব আলীদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের একেবারে সামনে চলে আসে। একই সময় পাকিস্তানিদের অন্যান্য দলও বিভিন্ন দিক থেকে সেখানে এগিয়ে আসে। জনাব আলীরা বীরবিক্রমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন। কিন্তু একটানা কয়েক দিন যুদ্ধ করে তাঁর বেশির ভাগ সহযোদ্ধা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ফলে তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থান নাজুক হয়ে পড়ে।
অসীম সাহসী জনাব আলী এতে দমে যাননি বা মনোবল হারাননি। সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। তাঁর অদম্য মনোবলে ক্লান্তিতে ভেঙেপড়া অনেক সহযোদ্ধা উজ্জীবিত হয়ে আবার যুদ্ধ শুরু করেন। সেদিনও তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। পাকিস্তানিদের অগ্রযাত্রা থেমে যায়।
২১ জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকটি দল তিন দিক থেকে জনাব আলীদের অবস্থানে আক্রমণ চালায়। এদিন আক্রমণকারী পাকিস্তানি সেনা সংখ্যায় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েক গুণ। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে তাঁদের অবস্থান ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। শেষে অধিনায়কের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। ওই দিন মনতলার পতন হয়।
জনাব আলী চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল জয়দেবপুরে। তখন তাঁর পদবি ছিল নায়েব সুবেদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে মনতলায় অবস্থান নেন। মনতলার পতন হলে ভারতে পুনঃ সংগঠিত হওয়ার পর প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরের পঞ্চবটি সাব-সেক্টরে, পরে এস ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। কয়েকটি যুদ্ধে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্ব ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য জনাব আলীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪৪।
জনাব আলী স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে অনারারি লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হয়ে ১৯৭৮ সালে অবসর নেন। ১৯৮৪ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার মিরাসানির নোয়াবাদী গ্রামে। বাবার নাম মোহাম্মদ আলী ভূঁইয়া, মা দুধরাজ বিবি। স্ত্রী সাজেদা মাহমুদা। তাঁদের তিন মেয়ে, তিন ছেলে। ছেলেমেয়েরা সবাই বিবাহিত। তিন ছেলেই চাকরিজীবী।
সূত্র: প্রথম আলোর আখাউড়া (ব্রহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি দুলাল ঘোষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.