পৃথিবী বাঁচাতে যা প্রয়োজন by শামসুল আরেফিন খান

পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম জোটের তিন যুগ স্থায়ী ক্ষমতার পাকাপোক্ত ভিত টলে গেল সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে টাটার শিল্প ভিত্তি গড়তে গিয়ে। ফায়দা লুটল মমতার তৃণমূল কংগ্রেস। মানুষ খেপাতে হাত বাড়াল কংগ্রেস মায় বিজেপিও। কৃষিক্ষেত পিষে-দলে শিল্পাঞ্চল গড়া,


এমনকি প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় আবাসনও, আধুনিক সভ্যতা প্রসারের ক্ষেত্রে কোনো নতুন ঘটনা নয়। তবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হরণ আর সাপের মাথায় পা দেওয়া প্রায় একই কথা, কখনো তা হয় বুকের পাঁজর ভাঙার মতোই কষ্টের ব্যাপার। তা সে ভোগদখলে লিপ্ত আদি বা অনাদি মালিক কিংবা জবরদখলকারী যেই হোক না কেন, সম্পত্তি হারালে কান্না তার পাবেই। সাম্রাজ্য হারিয়ে ইরানের শাহেন শাহ রেজা শাহ পাহলভিও সখেদে কেঁদেছিলেন : 'সারা জীবন যাদের ধামাধরে তাঁবেদারি করলাম, তারাই কিনা আমাকে মরা ইঁদুরের মতো আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করল' মর্মে মাতম করেন। ফিলিপাইনের স্বৈরাচারী শাসকের পত্নী ইমেলদা মার্কোস কান্না করেছিলেন বোধ করি রাজ্য শাসনের মৌরসিপাট্টার সঙ্গে সঙ্গে তিন হাজার জোড়া শখের বাহারি জুতা হারানোর দুঃখে। দেশনেত্রী খালেদা জিয়া অশ্রু ফেলেছিলেন অনেক স্মৃতিবিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি হারানোর বেদনায়। জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘে বসে ফাইল ছুড়ে ফেলে দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন ভেতো বাঙালির কাছে যুদ্ধে এবং বুদ্ধিতে হেরে। সেদিন ছিল ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১।
একাত্তরের এপ্রিলান্তে ঢাকা ছেড়ে আগরতলা-ধর্মনগর হয়ে করিমগঞ্জের নিলামবাজারে যে বাড়িতে প্রথম আশ্রয় পেয়েছিলাম সপরিবারে, তার আদি মালিকদের সহোদর দুজন একই মুহূর্তে হার্ট ফেল করে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন সেই ব্রিটিশ আমলে মূল্যবান জমির ওপর দিয়ে রেললাইন চলে যাওয়ায়।
জাপান ও চীনে এখন ঘণ্টায় ৩৫০ মাইল বেগে রেলগাড়ি ছুটছে। অথচ সেরা ধনী যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন থেকে নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত ৩৬৫ কিলোমিটার রেলপথ অতিক্রম করতে তিন থেকে চার ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। কারণ ক্ষিপ্রতর ট্রেন চলাচলের জন্য রেলপথ নতুন করে গড়তে বিশাল বনাঞ্চল উজাড় করতে হবে এবং তাও আবার ১০০ শতাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন। তাই কোনো সরকারই সাহসী হচ্ছে না খৰ তুলতে। এ কাজ কেবল বিপ্লবের দ্বারাই সম্ভব। এরশাদ সাহেব ১৯৮৪ সালে হুকুমদখলের যে নতুন আইন করেছেন, তেমনটি মার্কিন মুল্লুকে সম্ভব নয়। তা ছাড়া আইনবলে যে কার্যসিদ্ধি হবেই তা তো নিশ্চিত নয়। শুধু পশ্চিমাঞ্চলেই কেন, স্বদেশেও এর বিস্তর নমুনা মেলে। নতুন একটি সর্বাধুনিক সুপরিসর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য বিক্রমপুর অঞ্চলে ভূমি অধিগ্রহণ প্রচেষ্টা বিএনপির নেতৃত্বে জনপ্রতিরোধে ভেস্তে গেল। যশোরের মণিরামপুরে বিল, ভবদহের সর্বনাশা জলাবদ্ধতা নিরসনে জোয়ারাধার প্রকল্পের অগ্রযাত্রা ভণ্ডুল করেছিল ভূমিদস্যু ও ঘের মালিকদের প্ররোচনায়, কিছু স্বার্থান্বেষী ভূমি মালিক আত্মহত্যার নাটক করে এবং জনবিচ্ছিন্ন হুইপকে বেদম পিটিয়ে। তবে এখন ব্যাপারটা শুধু ব্যক্তিগত সম্পত্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। প্রকৃতির ওপর অপ্রকৃতির আগ্রাসন থমকে যাচ্ছে গণপ্রতিরোধের মুখে। পরিবেশবাদীরা সক্রিয় এবং প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছেন। কারণ মানুষের হৃদযন্ত্রটা নিষ্ক্রিয় হতে চলেছে কালো ধোঁয়ার মরণ ছোবলে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি ছয়বার বাইপাস করে শেষমেশ প্রাকৃতিক হার্টটা ছুড়ে ফেলে যান্ত্রিক হৃদয় সংযোজন করেছেন সাদ্দাম-উত্তর ইরাকে বেপরোয়া বেশুমার তেল দস্যুতার অর্থবলে। কিন্তু গরিব মানুষ কোথায় পাবে সে অমৃত প্রযুক্তি। তাই প্রতিরোধ ছাড়া তাদের বাঁচার কোনো উপায় থাকছে না।
ভারতে পরিবেশ আন্দোলনকারী সংগঠন গ্রিনপিস সম্প্রতি নতুন কয়লাখনির অনুমতি দেওয়া বন্ধ করার জন্য আবেদন জানিয়েছে। সে দেশের প্রায় ৫০ কোটি মানুষ সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভ্রাটের বিশাল উদ্ভবের উপর্যুপরি দুর্ঘটনায় একাধিক যুগল দিনরাত নানা দুর্ভর্োগের শিকার হয়েছিল। কাজেই সেখানে আরো বেশি করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু তাতে বৃথা নিপাতে প্রকৃতি ধ্বংসই শুধু নয়, সেখানে অবস্থিত বিশ্বের প্রায় অর্ধেকের বেশি বাঘের অভয়াশ্রমগুলোও হুমকির মুখে পড়তে চলেছে। ভারতের বনাঞ্চলে এক হাজার ৭০৬টি বাঘ আছে বলে সমীক্ষিত হয়েছে। গত পাঁচ বছরে ভারতে কয়লাখনি ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। কয়লাখনিগুলোর অবস্থান প্রায় ক্ষেত্রেই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে। এসব বিবেচনায় নিয়েই ২০১০ সালের অক্টোবরে মধ্যপ্রদেশের নরসিংহপুর জেলার প্রস্তাবিত ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করা হয়।
এদিকে ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে সুলতানা কামাল, মো. জাফর ইকবাল, রাশেদা কে চৌধুরীসহ ১২ বিশিষ্টজন বাগেরহাটের রামপালে সুন্দরবনের কাছে প্রস্তাবিত ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছেন। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বিপজ্জনক শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। কারণ তাতে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, মার্কারি বা পারদকণা, সিসা, আর্সেনিকসহ বহু ক্ষতিকর উপাদান নির্গত হয়। এমনকি কয়লা পোড়া ছাই ও কয়লা ধোয়া পানির সঙ্গে তেজষ্ক্রিয় ইউরেনিয়ামসহ থোরিয়ামও থাকতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রামপালে কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উপকূলীয় দুর্যোগের প্রাকৃতিক ঢাল সুন্দরবন ধ্বংস হবে। বিরল প্রজাতির গাঙ্গেয়ও ইরাবতি ডলফিন হারিয়ে যাবে। এই প্রজাতির ডলফিনের একমাত্র জন্মস্থান পশুর নদ মরে যাবে। বাড়বে খুলনাঞ্চলের লবণাক্ততা। বায়ুমণ্ডলে সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন যৌগ থেকে সৃষ্ট গ্রিন হাউস গ্যাসের কারণে এসিড বৃষ্টিও হতে পারে। গাছকাটা বনে আগুন লাগানো বাঘ, হরিণ ও কুমির মারা-ধরা তো খুবই মামুলি ব্যাপার, যা এখন অহরহই ঘটছে। যে যা-ই বলুন না কেন, সাফ কথা একটাই_অন্য যেখানেই হোক রামপালে কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্প কোনো মতেই করা যাবে না। দক্ষিণ গোলার্ধের আমাজন অরণ্যের মতো সংরক্ষণ করে পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন বাঁচাতে হবে। আমাদের একটি মাত্র গ্রহকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
এদিকে কর্ণফুলীর মোহনায় আনোয়ারা উপজেলায় প্রায় তিন হাজার ২০০ একর জমির ওপর আরেকটি ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা-বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জোর তোড়জোড় চলছে। সেটাও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও শাহ আমানত বিমানবন্দরের নিরাপত্তা হুমকি রোধ করতে এবং কর্ণফুলী নদীকে সম্ভাব্য দূষণ থেকে বাঁচাতে মহেশখালীতে স্থানান্তরের দাবি করা হচ্ছে। এলাকার মানুষ 'জান দেব রক্ত দেব_জমি দেব না' বলে শপথ নিচ্ছে। অথচ মহেশখালীতে পড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ বিরাণ খাসজমি সেগুলো ব্যবহার করতে কাউকেই কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া লাগবে না।
তা ছাড়া দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩২০০ থেকে ৬৫০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হওয়ায় বিদ্যুৎ সংকট এখন অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। আগামী এক বছরে আরো যেসব নির্মীয়মাণ প্রকল্পের উৎপাদন শুরু হবে, তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৮০০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত পেঁৗছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। কাজেই ধরে আনতে বললে বেঁধে আনার মহরত বাদ দিলেও মহাজোটের পুনর্নির্বাচনের পথে আর যা-ই হোক, বিদ্যুৎ ঘাটতি কোনো বাধা হবে না সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা।
e-mail : muktisakhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.