এসএসসি ’১২ অদম্য মেধাবী-আশার আলো ছড়িয়েছে ওরা

কেউ দিনমজুরের কাজ করেছে, কেউ ছাত্র পড়িয়ে রোজগার করেছে। কর্মকার বাবার কাজে সহায়তা ও ঝিয়ের কাজ করতে হয়েছে সংসারে সহায়তার জন্য। এসব খেটে খাওয়া পরিশ্রমী ছেলেমেয়ে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। এদের কয়েকজনের জীবনগাথা নিয়ে আজকের প্রতিবেদন।


অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে নির্বাচিত ৫০ জনকে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিল থেকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হবে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে নারী, প্রতিবন্ধী, সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী—এ বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়।
সেলিম রেজা: আড়াই বছর বয়সে বাবা আর অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় মা মারা যান। এরপর ছোট দুই ভাইয়ের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য দিনমজুরি শুরু করে সে। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তার। এ আগ্রহ থেকে স্থানীয় স্কুলশিক্ষক হাবিবুর রহমান তাকে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দেন। কারণ, নদীভাঙনে বসতঘর বিলীন হয়ে যাওয়ায় থাকার কোনো ঘর ছিল না তাদের। এই ছেলেটি এবার বাহুকা টেকনিক্যাল উচ্চবিদ্যালয় থেকে কারিগরি বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাদের বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার মেছরা ইউনিয়নের বেতুয়া গ্রামে। সেলিম বলে, ‘থাকা-খাওয়ার সুযোগ পাওয়ায় দিনমজুরির টাকায় লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছি। ক্লাস ঠিকমতো করেছি। মা জীবিত থাকার সময় বলেছিলেন, “ভালো করে লেখাপড়া কর, বড় হয়ে প্রকৌশলী হবি তুই”।’
হাফিজুন বেগম: ফল প্রকাশের দিন সকালে হাফিজুন প্রাইভেট পড়াতে ছাত্রের বাড়ি গিয়েছিল। বেলা আড়াইটায় বাড়ি ফিরে খুশির খবরটি জানতে পারে। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগরের হাজী মো. উস্তওয়ার বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। ভালো ফল করার পরও কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে তার সংশয়। কারণ, তার বাবা জমশেদ উদ্দীন তাদের কোনো খোঁজ-খবর নেন না। বড় ভাই বিয়ে করে আলাদা থাকেন। শুধু লেখাপড়া করার জন্য সে শমশেরনগর রেলওয়ে বস্তিতে তাঁর মাকে নিয়ে একটি ছোট ঘরে বাস করে। প্রাইভেট পড়িয়ে পাওয়া ১৫০০ টাকা ও স্বজনদের সহায়তায় কোনোমতে সংসার চলে তাদের। লেখাপড়া করে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখে হাফিজুন।
লিপেন চাকমা: ১৯৮৮ সালে পরিস্থিতির শিকার হয়ে উদ্বাস্তু হয় লিপেন চাকমার পরিবার। পরে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের দুর্গম পেরাছড়া গ্রামে এক ব্যক্তির দেওয়া জায়গায় আশ্রয় হয় তাদের। সংসারের খরচ জোগাড় করতে বাবার সঙ্গে জুমচাষ আর দিনমজুরি করতে হয় লিপেনকে। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মধ্য দিয়েও রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার সারোয়াতলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। লিপেনের বাবা তুষার বিন্দু চাকমা জানান, টানাটানির সংসারে ছেলেকে কলেজে ভর্তি করানোর ব্যাপারে তিনি চিন্তিত। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সবুজ জ্যোতি চাকমা বলেন, ‘লিপেন অনেক পরিশ্রমী ছেলে। অভাবের কারণে অনেক সময় বিদ্যালয়ে আসতে পারত না। তার পরও ক্লাসে সবার আগে পড়া দিত। উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেলে সে অবশ্যই ভালো করবে।’
রুকাইয়া-বিনতে-রেজা: রুকাইয়ার বাবা রেজওয়ানুননবী শিক্ষকতা করতেন। দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর চাকরি হারান তিনি। সেই সঙ্গে চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে গিয়ে জমিজমা, ভিটেমাটি, সহায়সম্বল সবই বিক্রি করে দিতে হয় তাঁকে। রুকাইয়া চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি মারা যান। এরপর কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে মা শাহিদা বেগম রুকাইয়াকে পাঠিয়ে দেন বগুড়া শহরের মালতিনগরে এক আত্মীয়ের বাসায়। সেখানে আশ্রিত থেকে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে হয়েছে তাকে। রুকাইয়া এবারের এসএসসি পরীক্ষায় বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার পুনট পাঁচপাইকা গ্রামে তাদের বাড়ি।
রুকাইয়া বলে, ‘বাবার স্বপ্ন ছিল আমি চিকিৎসক হব।’ মা শাহিদা রেজওয়ান বলেন, ‘স্বামীর মৃত্যুর পর দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ি। দরজির কাজ করে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করেছি। সেই কষ্ট বৃথা যায়নি।’
টুম্পা রানী সরকার: টুম্পার বাবা বিমল চন্দ্র সরকার পেশায় কর্মকার। সংসারের খরচ জোগাড় করতে টুম্পাকে প্রায়ই তার বাবাকে সাহায্য করতে হয়েছে। অভাবের কারণে বই কিনতে পারেনি সে। এভাবে দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে সে এবার সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার জনতা উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাদের বাড়ি সদর ইউনিয়নের কামলাবাজ গ্রামে। তিন বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। টুম্পা বলে, ‘অবসর সময়ে বাবাকে কাজে সহযোগিতা করেছি। বই কেনার সামর্থ্য না থাকায় সহপাঠীদের কাছ থেকে বই এনে পড়াশোনা করেছি। আমি আরও পড়তে চাই। আমি ভবিষ্যতে চিকিৎসক হতে চাই।’ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু সিদ্দিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘টুম্পা অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। তার স্বপ্ন পূরণে সহায়তা দরকার।’
শ্যামলী রানী দাস: দিনাজপুরের পার্বতীপুর জ্ঞানাঙ্কুর পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ অর্জন করেছে শৈশবেই মা-বাবা হারানো শ্যামলী রানী দাস। সে উপজেলার পূর্ব হুগলীপাড়া গ্রামের রামদেও দাস ও লক্ষ্মী রানী দাসের মেয়ে। মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে এক মাসের ব্যবধানে সে মা-বাবাকে হারায়। শ্যামলীরা তিন বোন, এক ভাই। মা-বাবার মৃত্যুর পর তিন বোনের ভরণপোষণের দায়ভার গিয়ে পড়ে ভাই ১৫ বছরের কিশোর রাজেনদেও দাসের ওপর। জীবিকা নির্বাহের কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত পূর্বপুরুষের পেশা জুতা সেলাইয়ের কাজে নামে সে। দুই শতক জমির পৈতৃক ভিটায় একমাত্র মাটির ঘরে ভাই-ভাবির সংসারে কাটে শ্যামলীর জীবন। ভাইবোনদের কেউই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়া শেষ করতে না পারলেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পেরেছে, এতেই তার আনন্দ। শ্যামলী রানী জানায়, অভাবের সংসারে সহায়তা করতে সে অন্যের বাড়িতে কাজ করেছে। তার একান্ত ইচ্ছা, সে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন এনামুল হক, সিরাজগঞ্জ; মুজিবুর রহমান, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার); সাধন বিকাশ চাকমা, বাঘাইছড়ি (রাঙামাটি); আনোয়ার পারভেজ, বগুড়া; সালেহ আহমদ, ধরমপাশা (সুনামগঞ্জ); আতাউর রহমান, পার্বতীপুর (দিনাজপুর)]

No comments

Powered by Blogger.