কয়লাখনি-‘উন্মুক্ত না, বিদেশি না, রপ্তানি না’: কেন? by আনু মুহাম্মদ

গত ১৪ জুন ২০১০ প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি লেখায় ভূতাত্ত্বিক ইউনুস আলী আকন উন্মুক্ত খনির পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন। ২০ জুন সরকারি দলের প্রভাবশালী সদস্য শেখ সেলিমও এই মতের পক্ষে সংসদে বক্তব্য দিয়েছেন। কয়েক মাস ধরে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, জ্বালানি উপদেষ্টা


তৌফিক এলাহী চৌধুরী, ভূমি প্রতিমন্ত্রী মুস্তাফিজুর রহমান, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হোসেন মনসুর প্রায়ই উন্মুক্ত খনির পক্ষে বলছেন, অর্থমন্ত্রী লিখিত নোটও পাঠিয়েছেন উচ্চপর্যায়ে। তাঁদের সবার মূল যুক্তি হলো: বিদ্যুৎসংকট সমাধানের জন্য উন্মুক্ত খনি পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের কোনো বিকল্প নেই! তাঁরা অবশ্য কেউ এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলেন না। এই প্রকল্প এখনো বাতিল হয়নি এবং এশিয়া এনার্জিও (বর্তমানে জিসিএম) তৎপরতা থাকায় উন্মুক্ত খনির পক্ষে অবস্থান কার্যত এশিয়া এনার্জির ওই প্রকল্পের পক্ষে অবস্থানেরই নামান্তর। তাঁরা কখনোই বলেন না, সেই প্রকল্প অনুযায়ী শতকরা ৮০ ভাগ কয়লা যদি বিদেশেই রপ্তানি হয় তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে কী দিয়ে?
ইউনুস আলী আকন বলেছেন, ‘যাঁরা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা কেউ কয়লা বিশেষজ্ঞ বা খনি প্রকৌশলী নন।’ তিনি অবশ্য বলেননি, যাঁরা পক্ষে বলছেন, তাঁদের কয়জন কয়লা বিশেষজ্ঞ বা খনি প্রকৌশলী? পক্ষে বলার জন্য কি বিশেষজ্ঞ জ্ঞান দরকার হয় না?
কেউ যতই পণ্ডিত হোন তিনি যদি ওই বিষয়ে কোনো কোম্পানির কর্মকর্তা হন কিংবা কনসালট্যান্সি করেন বা কোনোভাবে যদি ওই কোম্পানির সঙ্গে তাঁর বৈষয়িক সম্পর্ক থাকে, তাহলে আর তাঁর মতামত বিশেষজ্ঞ মতামত থাকে না, সেটা হয়ে দাঁড়ায় কোম্পানির পক্ষে একটি প্রচারণা। আমি বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কোনো স্বাধীন খনি বিশেষজ্ঞ বা ভূতাত্ত্বিককে উন্মুক্ত খনির পক্ষে কথা বলতে দেখিনি। বরং স্বাধীন জ্ঞানচর্চার সঙ্গে যুক্ত অনেক বিশেষজ্ঞ নিজেদের সামাজিক দায়বোধ থেকে উন্মুক্ত খনির বিপদ সম্পর্কে আমাদের সচেতন করেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. নূরুল ইসলাম, কানাডার রেজিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক এবং ভূতাত্ত্বিক ড. বদরুল ইমাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক এবং ভূতাত্ত্বিক ড. আফতাব আলম খান, যুক্তরাষ্ট্রের লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক এবং ভূতাত্ত্বিক ড. খালেকুজ্জামান, বিএইচপির সাবেক কনসালট্যান্ট ও ভূতাত্ত্বিক নজরুল ইসলাম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুল আলম, পেট্রোলিয়াম ও খনি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী এ কে এম শামসুদ্দীন, পানি বিশেষজ্ঞ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ইনামুল হক, প্রকৌশলী বি ডি রহমতুল্লাহ এবং ভূতাত্ত্বিক ড. রফিকুল ইসলাম, যিনি সমপ্রতি বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি নিয়েই জাপানে পিএইচডি গবেষণা সমাপ্ত করেছেন। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশলী শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কথা আর নাই বা বললাম।
ইউনুস আকন বলেছেন, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে শতকরা ৯০ ভাগ কয়লা উত্তোলন করা যায়। কিন্তু বলেননি, এই বিপুল পরিমাণ কয়লার মালিকানা কার হাতে থাকবে? যে কয়লা রাখতে দিনাজপুরের মতো শহরের সমান স্থান দরকার, তার মালিকানা যদি বাংলাদেশের না থাকে, যদি অধিকাংশ কয়লা বিদেশে রপ্তানি হয় এবং তার জন্য যদি ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হতে হয়, তাহলে কেন আমরা সেই পথ নেব?
তিনি আরও বলেছেন, বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লাখনি না করায় বাংলাদেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু কেন সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতি করা হয়নি? কেন ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনির উদ্যোগ থেকে অস্ট্রেলিয়ার খ্যাতনামা মাইনিং কোম্পানি বিএইচপি পিছিয়ে গেল? সে সময় তো কোনো জনপ্রতিরোধ ছিল না, তাহলে? ১৯৮৭-৯১ জুড়ে বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান মেসার্স ওয়ার্ডেল আর্মস্ট্রং বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে ‘টেকনো-ইকোনমিক ফিজিবিলিটি স্টাডি’ পরিচালনা করে। সমীক্ষা শেষে তাঁরা স্পষ্ট সিদ্ধান্ত টানেন, বাংলাদেশের ভূপ্রাকৃতিক গঠন বিশেষত পানির স্তরের কারণে উন্মুক্ত খনি কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
অন্যদিকে ১৯৯৪ সালে ফুলবাড়ী কয়লাখনি অনুসন্ধানের অধিকার লাভ করে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কয়লা কোম্পানি অস্ট্রেলিয়ার বিএইচপি। সে সময় এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ভূতাত্ত্বিক নজরুল ইসলাম। তিনি এখন সিডনিতে অবসরজীবন যাপন করছেন। ব্যক্তিগত আলোচনায় এবং সংবাদপত্রে লিখিত প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি জানিয়েছেন যে ফুলবাড়ী কয়লাখনির গভীরতা, বিশাল সমৃদ্ধ পানির স্তর ও ঘন জনবসতি দেখে বিএইচপি এই সিদ্ধান্তে আসে যে এখানে উন্মুক্ত খনি কারিগরি কারণেই করা সম্ভব নয়। এর ক্ষতি সামাল দেওয়ার অভিজ্ঞতাও তাদের নেই। এ জন্যই তারা সমৃদ্ধ খনির কর্তৃত্ব পেয়েও তা ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। সে সময় অর্থাৎ ১৯৯৭ সালেই গঠিত হয় এশিয়া এনার্জি। একটি সম্পূর্ণ নতুন ও অনভিজ্ঞ কোম্পানি রহস্যজনকভাবে একটি সমৃদ্ধ কয়লাখনির কর্তৃত্ব লাভ করে। বাংলাদেশের যোগ্যতা, দক্ষতা ও সক্ষমতা নিয়ে যাঁরা সন্দেহ প্রচার করেন, তাঁরা নতুন অনভিজ্ঞ কোম্পানির হাতে কয়লাখনি ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি করেননি।
যে কয়টি প্রধান কারণে আমরা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনকে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা, পানিসম্পদ, জ্বালানি নিরাপত্তা ও জননিরাপত্তা অর্থাৎ জাতীয় স্বার্থের জন্য বড় হুমকি মনে করি সেগুলোর মধ্যে আছে:
পানিসম্পদ: উন্মুক্ত খনির জন্য পুরো অঞ্চলকে শুকনো খটখটে করতে হবে, যার জন্য প্রতিদিন ৫০ থেকে ৮০ কোটি লিটার পানি ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। খনি এলাকা শুকনো বানানোর লক্ষ্যে এভাবে পানি প্রত্যাহার করতে থাকলে উত্তরবঙ্গের বিশাল অঞ্চলেও পানির স্তর নিচে নেমে যাবে। এ রকম বিপর্যয় সামাল দেওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত কোথাও নেই। বিশ্বব্যাপী যেখানে সুপেয় পানির সংকট, সেখানে নিজেদের বিশাল সম্পদ ধ্বংসের প্রস্তাব কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? পানির স্তর এভাবে নেমে গেলে খনি এলাকার বাইরেও বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ফসল, বৃক্ষরাজি উৎপাদন অসম্ভব হবে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ওপরের পানির অভূতপূর্ব দূষণ, যা জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদী-খাল-বিল হয়ে ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে।
আবাদি জমি: শুধু খনির কারণেই একটি বিশাল এলাকার তিন ফসলি আবাদি জমি বিনষ্ট হবে। এর বাইরেও পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও পানিদূষণের কারণে আরও বৃহত্তর অঞ্চলের জমি আবাদ অযোগ্য হয়ে পড়বে। সামগ্রিক খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা বড় আকারের হুমকির মধ্যে পড়বে।
প্রাণবৈচিত্র্য: এসিড ড্রেইনেজসহ দূষণযজ্ঞে প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি সমগ্র দেশের প্রতিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করবে।
জ্বালানি সম্পদ পাচার: এই সম্পদ অনবায়নযোগ্য, একবার তুলে ফেললে তা আর ভরানো বা পুনরুৎপাদন করা যায় না। তাই জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য মজুদ সীমিত থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী তুলে অনেক দিন ধরে ব্যবহার করাই ভালো। আর একবারে অনেকটা তুলে ব্যবহার করা যেহেতু বাংলাদেশের জন্য সম্ভব নয়, সেহেতু উন্মুক্ত পদ্ধতির অপরিহার্য পরিণতি বিপুল অংশের রপ্তানি। এবং বিদেশি মালিকানায় থাকায় এ রপ্তানি আয় বাংলাদেশ পাবে না।
অসংখ্য মানুষের জীবন ও জীবিকা। খনি অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষই শুধু নয়, পানিসম্পদ নষ্ট ও উর্বরতা বিনাশের কারণে উত্তরবঙ্গের বিশাল অঞ্চলের মানুষ কৃষি, গবাদিপশু, মৎস্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জীবিকার সংকটে সৃষ্টি হবে।
তাহলে এমন প্রকল্পকে কি উন্নয়ন প্রকল্প বলা যায়, যা আমাদের উৎকৃষ্ট মানের কয়লা দ্রুত বিদেশে পাচারের ব্যবস্থা করবে, এবং তা করার জন্য দেশের সমৃদ্ধ পানিসম্পদ ও বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উর্বর জমি বিনাশ করবে এবং কয়েক কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মধ্যে ফেলবে?
বর্তমান বিশ্বে মাটি-পানি-জীববৈচিত্র্যসহ সামগ্রিক পরিবেশ এবং জনবসতি ও জীবন-জীবিকার ওপর উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির বিষফল সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ছে। কোনো কোনো দেশে এই পদ্ধতি আইন করে নিষিদ্ধ হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে কয়লা সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য এখন নতুন নতুন অনেক পদ্ধতি নিয়ে কাজ হচ্ছে। উর্বর জমি, অমূল্য পানিসম্পদ ও মানুষের স্বার্থে বাংলাদেশের জন্য সঠিক পদ্ধতি বাছাই ও কার্যকর করার মতো যোগ্যতা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আমাদেরই দাঁড় করাতে হবে।
জীবন দিয়ে দেশের সম্পদ ও মানুষকে রক্ষা করে ফুলবাড়ীসহ উত্তরবঙ্গের বিশাল অংশের মানুষ তাঁদের আন্দোলন অবস্থানকে তিনটি কথায় প্রকাশ করেন: উন্মুক্ত না, বিদেশি না, রপ্তানি না। জনগণের এই সুস্পষ্ট রায় বা এই তিনটি ‘না’ প্রকৃতপক্ষে একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী ‘হ্যাঁ’কে প্রকাশ করে। সেগুলো হলো, দেশের সম্পদ দেশেই থাকবে, কোনো গোষ্ঠীর মুনাফা বা রপ্তানির জন্য নয়, বিদ্যুতায়ন ও শিল্পায়নসহ দেশের কাজে এই সম্পদের প্রতিটি বিন্দু কাজে লাগানোর জন্যই তার উত্তোলন হবে।
কয়লা সম্পদের সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য আমাদের প্রথম কাজ হলো সর্বনাশা ‘উন্মুক্ত খনি পদ্ধতি’ ও ‘খনিজ সম্পদ রপ্তানি’ নিষিদ্ধ করা। দ্বিতীয় হলো জাতীয় শতভাগ মালিকানা নিশ্চিত করে যথাযথ পদ্ধতিতে এই সম্পদের ব্যবহারের জন্য জাতীয় সংস্থা গঠন এবং শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে নতুন একটি দক্ষ প্রজন্ম গড়ে তোলার মাধ্যমে জাতীয় সক্ষমতার বিকাশ। তৃতীয়ত, এই কাজ সফলভাবে করার জন্য দুর্নীতিবাজ ও বিদেশি কোম্পানির স্বার্থরক্ষকদের রাহুগ্রাস থেকে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও দেশকে মুক্ত করা।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ। বিভাগীয় প্রধান, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.