প্রকৃতিকে পোষ মানিয়ে জাকারিয়ার আপন ভুবন by আল রাহমান

বাড়ির সামনে কোমরসমান একটি প্রাচীর। সেখানে শোভা বাড়াচ্ছে ৭৩টি শৈল্পিক গাছ। কোনোটা অ্যানাকোন্ডা সাপ, কোনোটা জাতীয় স্মৃতিসৌধ কিংবা মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য, কোনোটা অন্তঃসত্ত্বা মা, আবার একটিতে দেখা গেল ব্রুসলির হাতের পাঁচ আঙুল। একটু এগোলে বাঁশের মাচান। ওই মাচানের ওপর আছে আরও অর্ধশতাধিক।
ঘরে ঢোকার দুই পাশে যে একচিলতে জায়গা তাতেও আছে হরেক গাছ আর বাঁশ। একটি বাঁশের আকৃতি কলসির মতো, নামও তা-ই ‘কলসি বাঁশ’। বসার ঘরে আছে বেশ সুন্দর ছয়টি গাছ। আর ছাদে তো এলাহি কারবার! ছোট-বড়-মাঝারি আকারের শত বনসাই। চেরিগাছে ফুল ফুটেছে। গাছেই শুকিয়ে আছে কিছু ডালিম। গত শনিবার নগরের পাহাড়তলী সরাইপাড়ায় বনসাই শিল্পী এম জি জাকারিয়ার বাড়িতে দেখা গেছে এমন চিত্র।
জাকারিয়া জানালেন, তাঁর কাছে ১৩২ প্রজাতির চার শতাধিক গাছের বনসাই আছে। এর মধ্যে বটগাছ আছে প্রায় আট ধরনের—চায়না, কুচি, নুড়া, জাবা, কাঁঠালি, পাইকাস ইত্যাদি। ছাদে রেখেছেন শেওড়া, খইয়াবাবলা, টগর, রাজকড়াই, আম, সাজনা, আরবড়ই (স্থানীয় নাম ফরফরি), সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, গাব, চাঁপা, তেঁতুল, হরীতকী, আমলকী, বহেড়া, অর্জুন, নিম, কামরাঙা, চালতা, করমচা, কতবেল, তমাল, হিজল, পারুল, মেহেদি, গামারি, মহুয়া, অশোক, স্বর্ণবটি, জামরুল, কালোজাম, আরবি খেজুরগাছের বনসাই। বসতবাড়ির আশপাশে এবং প্রাচীরের ওপর রেখেছেন শাল, জুঁই, ক্যাকটাস, এরেন্ডা, গোলাপজাম, সফেদা, ইউক্যালিপটাস, নীলকণ্ঠ, এলাচিলেবু, জেটপ্লান্ট, বেলি, জামরুল, ঝাউপাইন, তারামণ্ডল (পোকেনট্রি), নলিবাঁশ ইত্যাদি গাছের বনসাই।
কেমন করে বনসাইয়ের প্রেমে পড়লেন?
জাকারিয়ার জবাব, ‘তখন ১৯৯৩ সাল। বাড়ির ছাদে কনক্রিটের স্তূপের ওপর একটি বটগাছ দেখলাম অযত্নে বেড়ে উঠছে। মায়া হলো খুব। চারাটি টবে লাগিয়ে দিলাম। ছোট আকৃতির বড় গাছটির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হলাম। বাসা-বাড়ির দেয়াল, নালা-নর্দমা থেকে এ ধরনের আরও চারা সংগ্রহ করে নেমে পড়লাম। এটা ঠিক আমার কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। নিজে নিজেই শুরু করেছিলাম। প্রদর্শনীও করে ফেললাম। বোদ্ধা দর্শকেরা বললেন, বনসাইয়ের বৈশিষ্ট্য থাকে, গ্রামার থাকে। অবাক হলাম। পরে খোঁজ নিয়ে ২০০১ সালে বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটির সদস্য সাব্বির সারোয়ারের কাছে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নিলাম।’
বনসাইয়ের জন্য অনেক গাছ সংগ্রহ করেছেন আপনি। কীভাবে করলেন?
‘বিভিন্ন নার্সারি থেকে বিদেশি গাছের কিছু চারা সংগ্রহ করেছি। এ ছাড়া, রাজশাহী থেকে খইয়াবাবলা ও বারোমাসি আমের চারা এনেছি যে গাছের বনসাইতে আমও ধরেছে। সিলেট থেকে চা-গাছ, সুন্দরবন থেকে গেওয়া, গরান, সুন্দরী, গোলপাতার চারা এনেছিলাম বনসাই তৈরির জন্য। কিন্তু বেশি দিন বাঁচেনি গাছগুলো, আবহাওয়া-মাটি অনুকূল ছিল না। তবে বরিশাল থেকে যে চায়না কমলার গাছ এনেছি সেটাতে অনেক ফল ধরে ফি বছর। এ ছাড়া ঢাকা থেকে এনেছি থাইল্যান্ডের কলসি বাঁশের চারা। বেঁচে আছে।’
এখন তো আপনি নিজেই প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। সে ব্যাপারে কিছু বলবেন?
‘আমি তো বাড়ির ছাদে বাগান সৃজন বিভাগে জাতীয় পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছি। পেয়েছি অনেক বৃক্ষপ্রেমীর ভালোবাসা। আসলে আমি প্রশিক্ষণ দিচ্ছি সঠিক ভাবে বনসাই তৈরির। এ শিল্পের কৌশলগুলো আমি তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। অগভীর পাত্রে গাছ লাগিয়ে দিলেই তো বনসাই হয় না। জাপানি ১৬টি পদ্ধতির যেকোনো একটি বৈশিষ্ট্য থাকলেই বনসাই বলা যাবে। অর্থাৎ বনসাই হচ্ছে শৈল্পিক গাছ।’
আপনি কি শখের বশে এ কাজ করেন, এ খাতে আপনার আয় কেমন হচ্ছে?
‘শখ তো বটেই। নইলে এত কষ্ট কেন করছি। আমি যখন চট্টগ্রামে বনসাই নিয়ে কাজ শুরু করি তখন মাটির অগভীর পাত্র পাওয়া যেত না। প্লাস্টিকের ঝুড়ি কিনে সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে অগভীর পাত্র বানাতাম। অবশ্য এটাও ঠিক এখন বনসাই বিক্রি আর প্রশিক্ষণ দিয়ে বছরে দুই লক্ষাধিক টাকা আয় করছি। পাঁচ দিনের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের জন্য ৬০০ টাকা নিয়ে থাকি।’
আপনার বনসাইয়ের দরদাম সম্পর্কে বলবেন?
‘আমার কাছে ৫০০ থেকে তিন লাখ টাকা দামের বনসাই আছে। গাছের বয়স, শৈল্পিক রূপ—এসবের ওপরই দাম নির্ভর করে। আমি তো নার্সারি মালিক নই যে যেনতেন ভাবে গ্রাহকের পকেট কাটব। ওরা কোন আবহাওয়া, কোন পরিবেশে গাছ বাঁচবে, কেমন খাবার দিতে হবে, কীভাবে পরিচর্যা করবে তা ক্রেতাদের ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন না। ফলে অল্পদিনে গাছ মারা যায়। এতে বনসাই শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এটা তো উচিত নয়। আমি শিল্পী। একটি গাছের প্রাণ আমার কাছে সন্তানের মতোই দামি। ক্রেতা সঠিক পরিচর্যা করতে পারবে না মনে হলে আমি বনসাই বিক্রি করি না।’
আপনার পরিবারের সহযোগিতা পান?
‘অবশ্যই। নইলে এতগুলো বনসাইয়ের টবে প্রতিদিন পানি দেওয়া, সময়মতো কম্পোস্ট সার দেওয়া, ডাল-পাতা ছাঁটাই করা, আলো-বাতাস-রোদ লাগানো এসব একা করা সম্ভব নয়। আমার স্ত্রী মুরশিদ জাকারিয়া, পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে মুশফিকা ও দ্বিতীয় শ্রেণীর মাইশা, ভাই এম জি সারোয়ার ও এম জি সাকারিয়া—সবাই গাছের পরিচর্যা করে। সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আমার মা জয়গন নেছার।’
বনসাই নিয়ে এমন কোনো ঘটনা আছে যখন খুব কষ্ট পেয়েছিলেন?
‘অনেক ঘটনা। আমার একটি ১৫ বছর বয়সী চালতাগাছের সুন্দর বনসাই ছিল। আমি সন্তানের মতোই ভালোবাসতাম গাছটিকে। একবার টব বদলানোর সময় আবহাওয়া প্রতিকূলে থাকায় গাছটি মারা যায়। পরিবারের সদস্যদের খুব মন খারাপ হয়েছিল। আমি অনেক কেঁদেছিলাম।’
আগামী দিনের কোনো স্বপ্ন আছে আপনার?
‘আমার একটি বড় স্বপ্ন চট্টগ্রামে একটি বনসাই শিল্পীদের অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলা। এ ছাড়া বছরে একটি বনসাই মেলা করতে চাই।’

No comments

Powered by Blogger.