অর্থনীতির ভালো সূচকগুলো আরও খারাপ হয়েছে by শওকত হোসেন

অর্থনীতির সূচকগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হচ্ছে অর্থমন্ত্রীর সূচক। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ঠিকঠাক রাখতে অর্থমন্ত্রী এসব সূচকের দিকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখেন। যেমন বাজেট ঘাটতি, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ, ভর্তুকি ও সুদ পরিশোধ ব্যয়, লেনদেনের ভারসাম্য ইত্যাদি। অর্থমন্ত্রীর প্রতিটি সূচকই গত এক বছরে খারাপ হয়েছে।


কিছু সূচক ব্যবসায়ীদের জন্য। যেমন ব্যাংকঋণ, সুদের হার, ডলারের বিনিময় মূল্য, জ্বালানির প্রাপ্যতা, আমদানি, রপ্তানি ইত্যাদি। এ সূচকগুলোও গত এক বছরে আরও খারাপ হয়েছে। ফলে হ্রাস পেয়েছে বেসরকারি বিনিয়োগ।
অর্থনীতির বাকি সূচকগুলো সাধারণ মানুষের জন্য। প্রতিদিনকার জীবনযাপন কতটা ভালো হলো, সীমিত আয়ের মানুষের আয়ের তুলনায় ব্যয় কত বাড়ল, আগের চেয়ে তারা কতটা ভালো আছে—সাধারণ মানুষ এসবই বুঝতে চায় অর্থনীতির সূচক থেকে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এর মধ্যে চলে আসে বাড়িভাড়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে খরচ, পরিবহন ব্যয়, পানি ও বিদ্যুতের দাম ইত্যাদি। গত এক বছরে এর কোনো ক্ষেত্রেই ভালো কোনো খবর ছিল না।
এ রকম এক অর্থনীতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগামী ২০১২-১৩ অর্থবছরের নতুন বাজেট দিচ্ছেন। বলা যায়, গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপের মধ্যে থাকা অর্থনীতি হাতে নিয়ে বাজেট দিতে হচ্ছে অর্থমন্ত্রীকে। গত এক বছরে যেসব সূচক অর্থনীতির জন্য ভালো, সেগুলো খারাপ হয়েছে। আর যেসব সূচক ঊর্ধ্বমুখী হওয়া খারাপ, সেগুলো ঊর্ধ্বমুখীই রয়ে গেছে।
তার পরও অর্থমন্ত্রী বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়ার সময় খানিকটা স্বস্তিতে থাকবেন মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নিয়ে। কেননা, এ রকম এক অবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে এবার জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে প্রবৃদ্ধি হতে পারে সাড়ে ৫ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট, ব্যাংকঋণের সুদ বা ডলারের হার এবং ব্যাংক থেকে সরকারের সব ঋণ নেওয়া নিয়ে যতই সমালোচনা করুক, সরকারি কাগজ বলছে এবার মোট বিনিয়োগ জিডিপির ২৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ হয়েছে। আর দেশের মানুষ প্রতিদিন জীবনযাত্রায় যতই কষ্টে থাকুক, তাদের মাথাপিছু আয় কিন্তু ৭৪৮ থেকে বেড়ে ৭৭২ ডলার হচ্ছে।
যদিও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জিডিপির প্রবৃদ্ধির নতুন হিসাবের যথার্থতা নিয়ে সন্দিহান। তিনি বলেছেন, বিবিএস যে হিসাব প্রাক্কলন করেছে, সেটাও বেশি মনে হচ্ছে। কেননা, রপ্তানি কমেছে। আবার মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানিও কমেছে। আমদানি খরচ বেড়েছে।
অনেকগুলো ভুল অনুমান: চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরটি শুরুই হয়েছিল নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্য দিয়ে। এর পরের টানা প্রায় নয় মাস সেই চাপ আরও বেড়েছে। অর্থাৎ অর্থবছরের শেষ সময়ে এসে অর্থনীতির কোনো কোনো সূচকের খানিকটা উন্নতি হলেও সামগ্রিক চাপ এখনো রয়ে গেছে।
চলতি অর্থবছর শুরুই হয়েছিল কতগুলো ভুল অনুমানের ওপর ভিত্তি করে। প্রায় প্রতিটি অনুমানই ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। বাজেট বক্তৃতার শুরুতেই অর্থমন্ত্রী সামষ্টিক অর্থনীতি ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করে বলেছিলেন, ‘বৈদেশিক খাতবিষয়ক প্রায় সব সূচকই সন্তোষজনক অবস্থায় আছে।’ অথচ অর্থবছরের শুরু থেকেই অর্থমন্ত্রী সবচেয়ে বড় সংকটে ছিলেন এ বৈদেশিক খাত নিয়ে। সামষ্টিক অর্থনীতির চাপটা এ সময় প্রায় পুরোটা এসেছে বৈদেশিক খাত থেকে।
বাজেটকাঠামো অধ্যায়ে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘একটি মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে অন্তর্নিহিত কতিপয় অনুমানের ওপর ভিত্তি করে’ তিনি নতুন বাজেট তৈরি করেছেন। অনুমানগুলো হলো, বিশ্ববাণিজ্যের গতি ফিরে আসা, রপ্তানি বাণিজ্যে দেশের সুদৃঢ় অবস্থান, রাজস্ব আহরণের সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি, কৃষি খাতে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি এবং মেয়াদি শিল্পঋণের উচ্চ প্রবৃদ্ধি। এসব অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই অর্থমন্ত্রী এবার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ হবে বলে ধরে নিয়েছিলেন।
অথচ চলতি অর্থবছরে বিশ্ববাণিজ্যের গতি ফিরে আসেনি, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অনেক কমেছে, বিনিয়োগ-পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, কমেছে কৃষির প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, কমেছে পুঁজি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি, সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, মূল্যস্ফীতির চাপ ছিল সারা বছর ধরে, টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে দ্রুতগতিতে, লেনদেনের ভারসাম্যে ছিল বছরজুড়ে চাপ। একমাত্র ভালো খবর ছিল রাজস্ব আদায়ে ভালো প্রবৃদ্ধি।
ব্যাংকব্যবস্থায় সরকারের ঋণ: চলতি অর্থবছরের পুরো বাজেট পরিসংখ্যানই এলোমেলো হয়ে গেছে। সরকারের করা একটি হিসাবও ঠিক থাকেনি। বিশেষ করে ব্যয়ের হিসাব একটিও মিলছে না। প্রাক্কলনের তুলনায় ভর্তুকি ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার পায়নি কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক সহায়তা। সাধারণ মানুষ সঞ্চয়পত্র থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এর ফলে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারকে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ নিতে হয়েছে।
সরকারের পরিকল্পনা ছিল চলতি অর্থবছরে সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ঘাটতি অর্থায়ন করবে। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই সরকারের ঋণ সারা বছরের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ফলে শেষ সময়ে এসে লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা করেছে সরকার। অথচ গত অর্থবছরে সরকারের নেওয়া ঋণ ছিল ১৯ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা।
মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে সেই অর্থ দিয়েছে সরকারকে। এর ফলে বাজারে নগদ টাকার সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ আরও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরাও এ জন্য সমালোচনা করেছেন সরকারের। তবে শেষ পর্যন্ত নতুন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সরকারের ঋণ থাকবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। কেননা, গত অর্থবছরের শেষ দুই মাসেই প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছিল।
কমেছে আমদানি: গত অর্থবছরে আমদানি খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৪১ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাস অর্থাৎ মার্চ মাস পর্যন্ত সময়ে আমদানি প্রবৃদ্ধি মাত্র ১১ দশমিক ২২ শতাংশ। এ সময়ে ভোগ্যপণ্য আর জ্বালানি তেল ও তেলজাতীয় পণ্যের আমদানিই কেবল বেড়েছে। অন্যদিকে কমেছে শিল্পের কাঁচামাল ও পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৬ শতাংশ। আবার বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার কারণে এসব পণ্য আমদানির জন্য নতুন ঋণপত্র খোলার পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে চলতি অর্থবছরে।
সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরজুড়েই অর্থনীতি ছিল চাপের মধ্যে। এবার ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১০ শতাংশের বেশি। একপর্যায়ে তা ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলেও মার্চের পর ডলারের দর খানিকটা কমেছে। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, মানুষের সঞ্চয় কমছে। চলতি অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয় ২৬ থেকে কমে ২৫ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে। ভর্তুকি বাড়ার কারণে সরকারি সঞ্চয় কমেছে আর শেয়ারবাজারের বিপর্যয় এবং মূল্যস্ফীতির কারণে কমেছে ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের পরিমাণ।
নতুন বাজেট হবে বর্তমান সরকারের বাস্তবায়নযোগ্য শেষ বাজেট। এর মাধ্যমে অর্থমন্ত্রীকে মূল্যস্ফীতি রাখতে হবে নিয়ন্ত্রণে, বাড়াতে হবে বিনিয়োগ। আবার অর্থমন্ত্রীকে থাকতে হবে আইএমএফের ঋণকাঠামোর আওতায়। ফলে জ্বালানির দাম বাড়ানোর মতো অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবার নির্বাচনী ভাবনায় চাপ থাকবে জনতুষ্ট বাজেট করার। এর মধ্যেই ৭ দশমিক ২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। সুতরাং, আগামী বাজেট হবে অর্থমন্ত্রীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

No comments

Powered by Blogger.