ভবদহে ক্ষোভের আগুন বহুদিনের by ফখরে আলম

এলাকার মানুষের দুঃখ 'ভবদহের জলাবদ্ধতা' নিরসনে সরকারের জোয়ারাধার গড়ার প্রকল্প নিয়ে গত শনিবার জাতীয় সংসদের হুইপের ওপর হামলাসহ যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটল, তার পেছনে অনেক কারণ। জোয়ারাধারের বিপক্ষে চিংড়িঘের মালিকদের যেমন ইন্ধন রয়েছে, আছে প্রকল্পের প্রতি এলাকাবাসীর আস্থাহীনতা ও সন্দেহ।


এর আগে ভবদহের একটি অংশে জোয়ারাধার গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উদাসীনতায় তা ব্যর্থ হয়ে যায়। আরেক অংশে প্রকল্প চালু করার পর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা সময়মতো ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের কাছে তাঁদের বারবার ধরনা দিতে হয়।
পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিরাও কৃষকদের মন থেকে অবিশ্বাস দূর করতে পারেননি। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, একমাত্র জোয়ারাধারই ভবদহের জলাবদ্ধতা দূর করতে পারবে। সরেজমিন জোয়ারাধার প্রকল্পের বিল এলাকা ঘুরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত শনিবার হাজার হাজার মানুষ ভবদহের বিলকপালিয়ায় জোয়ারাধার প্রকল্পের কাজ উদ্বোধনের সময় হুইপসহ কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালায়, সরকারি যানবাহন পুড়িয়ে দেয়। ভবদহ এলাকার মানুষ জোয়ারাধারের পক্ষে-বিপক্ষে এখন দুই ভাগ হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। এক দলের ভাষ্য হচ্ছে, জোয়ারাধার ছাড়া জলাবদ্ধতা দূর হবে না। অন্য দল বলছে, জোয়ারাধার ফের এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করবে।
জোয়ারাধার পরিকল্পনাটি হচ্ছে, পলিবাহিত জোয়ারের পানি উঠিয়ে বিলের তলদেশ উঁচু করা। এতে নদী ফিরে পাবে নাব্যতা। জলাবদ্ধ বিলে ফসল ফলবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত শতাব্দীর ষাটের দশকে নির্মিত শ্রীনদী-টেকা নদীর ভবদহ স্লুইসগেটের মুখ আশির দশকে ভরাট হয়ে যায়। এ কারণে সৃষ্টি হয় স্থায়ী জলাবদ্ধতা। যশোরের মণিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর, খুলনার ফুলতলা, দৌলতপুর, ডুমুরিয়া এলাকার প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে ১০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। এই জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ড একের পর এক প্রকল্প গ্রহণ করে। যশোর-খুলনা পানিনিষ্কাশন প্রকল্পের নামে খরচ করা হয় ২৫২ কোটি টাকা। এতে কিছুটা সুফল পাওয়া যায়। তবে কোনো কোনো অঞ্চলে জলাবদ্ধতা থেকে যায়। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য ১৯৯৭ সালে প্রথমে বিল কেদারিয়ায় জোয়ারাধার প্রকল্প চালু করা হয়। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতায় তা ব্যর্থ হয়। ২০০৫ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড বিল খুকশিয়ায় জোয়ারাধার প্রকল্প চালু করে। সিদ্ধান্ত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জমি বাবদ ক্ষতি পূরণ দেওয়া হবে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, কৃষকরা ওই ক্ষতি পূরণের টাকা সময়মতো পাননি। টাকা পাওয়ার জন্য অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে।
জানা যায়, প্রতি একর জমির ক্ষতিপূরণের জন্য পাউবো বছরে ১৬ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ঘের মালিকরা চিংড়িচাষে লিজ নেওয়া জমির জন্য মালিকদের দেন প্রতি একরে আট হাজার টাকা। এ কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে বাদ সাধেন স্থানীয় ঘেরমালিকরা। এ ছাড়া ভবদহের জলাবদ্ধতা দূর হয়ে গেলে সেখানে আর চিংড়িঘেরই থাকবে না। তাই ঘেরমালিকদের জোয়ারাধারের বিরুদ্ধাচরণ শুরু থেকেই। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, জোয়ারাধার প্রকল্পের এলাকায় সরকারের খাসজমিও রয়েছে। এসব জমি অবৈধ দখলে নিয়ে ঘের করা হয়েছে। কাজেই স্থানীয় প্রভাবশালী স্বার্থান্বেষী একটি মহল জোয়ারাধার প্রকল্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
এমন পরিস্থিতিতে পাউবো বিল কপালিয়া এলাকায় ২৭ কোটি টাকার একটি জোয়ারাধার প্রকল্প গ্রহণ করে। এরই মধ্যে এই প্রকল্পের মণিরামপুর অংশে ২৭ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, অনেক কৃষক জমির ক্ষতিপূরণের টাকা হাতে পাননি। অনেকে মনে করেছেন, পাউবোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিশেষ সুবিধা নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জোয়ারাধার প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চাইছেন। এসব প্রচার-প্রচারণায় একটি মহল, বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কিছু কর্মকর্তা অংশ নিয়ে এলাকাবাসীকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। গত শনিবার তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করছে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি। পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য যশোর জেলা সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ এ ব্যাপারে বলেন, 'বিল খুকশিয়ায় জোয়ারাধারের ক্ষতিপূরণের টাকা অনেক কৃষক পাননি। ফলে সন্দেহ-অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। আমরা কৃষকদের হাতে হাতে টাকা দেওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দাবি জানাই। কিন্তু কৃষকদের সহজে টাকা দেওয়া হয়নি।' তিনি বলেন, 'আমাদের বক্তব্য ছিল, নায়েব হাটবাজারে যাবে। জমির কাগজ দেখে ক্ষতিগ্রসস্তদের ক্ষতিপূরণ দেবে। কিন্তু তা করা হয়নি। অন্যদিকে ঘেরমালিকরা নিজেদের স্বার্থে প্রচার প্রপাগাণ্ডা চালিয়েছে। আস্থাহীনতার সংকটে গত শনিবার অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনা ঘটেছে।'
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মশিউর রহমান বলেন, 'ভবদহের স্থায়ী জলাবদ্ধতা নিরসনে বিল কপালিয়ায় জোয়ারাধারের কোনো বিকল্প নেই। এর সঙ্গে স্থানীয় কৃষকরা আছেন।' হামলা আহত হুইপ অধ্যক্ষ আবদুল ওহাব বলেন, 'জোয়ারাধার চালু হলে ২০ লাখ লোক জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পাবে। কিছু ঘেরমালিক, মধ্যস্বত্বভোগী, বিএনপি, জামায়াত, এনজিওর লোক জোয়ারাধারের বিরোধিতা করে গত শনিবারের ঘটনা ঘটিয়েছে।'

No comments

Powered by Blogger.