স্মরণ-এমন মানুষও ছিল একদিন by বিপ্লব বালা

মানুষের মতো মানুষ সত্যিই ছিল একদিন, যাঁদের ছিল মানুষের মতো মান আর হুঁশ। শতবর্ষ আগের এক নাটকে যেমন সংলাপ ছিল, ‘নিজের জন্য তো শেয়াল কুকুরেও কাঁদে, মানুষের কান্না যে পরের জন্য।’ গৃহবিবাগী একদল মানুষ তেমনি ছিল একদিন সমাজে, এই বাংলাদেশে। সত্যিই তাঁরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াতেন।


কথাটা তো আর এমনি এমনি হয়নি। ঘর-সংসারে থেকেও তাঁরা ছিলেন যেন সবার, দেশ-সমাজেরই একজন। কেবল নিজের মুক্তির জন্য তো সংসার ছাড়তেন না তাঁরা। সবার মধ্যে থেকেই সমাজের কাজ করা ছিল তাঁদের ধ্যান-জ্ঞান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকেই এমন মানুষ বেশি করে চোখে পড়ত। উপমহাদেশজুড়ে এমন মানুষ সব জড়ো হয়েছিলেন সবার আগে গান্ধী মহারাজের ডাকে। জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভেদ ছিল না তাতে; বরং এই ভেদ ঘোচানোও ছিল তাঁদের বড় এক ব্রত, ব্রিটিশ তাড়ানোর পাশাপাশি। বাংলায় নেতাজি সুভাষ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন আর শেরেবাংলা, ভাসানীর ডাকে কত মানুষ যে ঘর ছেড়েছিল একদিন। সমাজের, দেশের কাজে পথে নেমেছিল। যার সব শেষ, সব সেরা জোয়ার জাগায় শেখ মুজিব বা শ্যাখ সাব কি মুজিব ভাই।
মুসলিম লীগের নেতা-কর্মী ছিলেন তো উচ্চশ্রেণীর অভিজাত ধনীর দল। আওয়ামী লীগ সেটা নামিয়ে ছড়িয়ে দেয় মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত যত সাধারণজনের মাঝে। তাঁরাই তো দেশজুড়ে যত সংগ্রাম-আন্দোলন করেছেন। নইলে শহরের নেতা, ছাত্র-যুবকের সাধ্য কী, তাঁদের ছাড়া এমন সব একেক ঘটনা ঘটায়। তাঁরাই তো ছিলেন দলের, দেশের আসল খুঁটি। মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তাঁরাই আসল নেতৃত্ব দিয়েছেন। গ্রাম-বাংলার দেশ-সমাজজুড়েই। বঙ্গবন্ধু তাদেরই নেতা, ছিলেন বড় আপনজন—মুজিব ভাই। তাদের সবার সঙ্গেই ছিল যেন তাঁর জান পেহসান, পরানের প্রণয়। আর তারাই কিনা পিছিয়ে পড়ে, হটে যায় স্বাধীনতার পরেকার যত উঠতি কালো টাকার মাস্তান আর নেতা-ক্যাডারের কাছে। পাড়ার যত গুণ্ডা-পাণ্ডারাই নেতা হয়ে বসে তখন। মাস্তান মানেই যেন মহা মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুও এদের দ্বারা অতিষ্ঠ হয়েউঠেছিলেন। আর সেই বিষবৃক্ষ আজ তো হাজার মাথা দৈত্য-দানব হয়ে ঘিরে ধরেছে দল-দেশ-সমাজ। আগে ‘ছাত্র’ শুনলে সবাই যেমন সম্মান আর সমীহ করত, আর আজ? ছাত্রনেতা শুনলে তো কথাই নেই—ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি।
রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির গৌর গোস্বামী ছিলেন রূপকথার সেই যুগের একজন। গ্রাম-সমাজের সবার এক আপনজন। সুখে-দুঃখে তাঁর কাছে তাই হাজির হতো তারা সবাই। ধনীসম্পন্ন ঘরের সন্তান ছিলেন তিনি। তাঁর বাবা নাকি হাতিতে চড়ে বেড়াতেন। জজ কোর্টের জুরিও ছিলেন। তবে তিনি তো ’৪৭ সালের আগে গান্ধির চ্যালা, কংগ্রেসের কর্মী ছিলেন। দেশ ভাগে সম্পন্নপ্রায় সব হিন্দুই তো দেশ ছাড়ে। তিনি ছাড়েননি। পাকিস্তান আমলে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন। এভাবে তিনি হয়ে ওঠেন সহজিয়া এক মুজিবপন্থী। এ কাজে সংসার করেও ছিলেন তিনি গৃহবিবাগী, যেন বা এক সন্ন্যাসী, ‘ঘর কইনু বাহির আর বাহির ঘর’, যেন চিরকালের ঘরছাড়া বাঙালি এক। আর তাঁরই ভুক্তভোগী হয়েছে পরিবার, হাড়ে হাড়ে খেসারত দিয়ে দিয়ে। তাতেও তাঁর যেন ছিল না কোনো হায় আফসোস! ’৭০-৭৩ সালের নির্বাচনে নৌকার স্থানীয় এক বড় সংগঠক ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকালে শরণার্থী শিবিরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় অতন্দ্র ছিলেন। তাঁর কোনো বিনিময় তো পাননি, চানওনি সেভাবে। স্বভাবতই এহেন সত্যযুগের কর্মীজন কালো টাকা, মাস্তানির নব্য আওয়ামী লীগের হাতে হয়েছেন ধরাশায়ী, বাতিল। আজকের এই ‘খাই খাই’ বাজারি রাজনীতিতে তাই তো হওয়ার কথা। দেশ-সমাজ-সম্পর্কহীন অর্ধমানব-অর্ধপ্রাণী এই এক পণ্যপ্রজাতি প্রজন্মের ঊর্ধ্বতনে, বিস্মৃত ফসিলবৎ হবেই তো রূপকথার যুগের মানুষেরা। তবু শোনো বলি সে গল্পকথা, এমন মানুষও যে ছিল একদিন। দেখা হলেই চিবুকে হাত বুলিয়ে, বড় প্রসন্ন হাসিমুখে আদরের স্নেহচুম্বন করে শুধাতেন, সজল মানবস্বরে, ‘কেমন আছিসরে মণি?’ যদিও তাঁর মতো অমন ব্যর্থ, অসফলজনে কে আর পোছে? গ্রামদেশেও তিনি হয়ে ওঠেন ঢাল-তলোয়ারহীন এক নিধিরাম সর্দার, অথবা দন কিহোতো। ক্ষমতাহীন তাঁর কাছে ঘেঁষত না তাই কেউই প্রায় শেষের দিকে। আর তাঁর নিকটজনেরাও কি তাঁকে বাতিল, অলাভজনক মনে করেনি? ঢাকায় তাঁর মেয়েদের বাড়িতেও তাই কি আর যেতেন না তেমন? আয়নেস্কোর চরিত্রের মতোন নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন বুঝি। কাউকে বুঝতে না পেরে আর নিজেকেও কারও কাছে বোঝাতে না পেরে।
হয়তো বড়ই অমোঘ, অনিবার্য তাঁর এই নিয়তি। হয়ে উঠেছিলেন তিনি যে এক প্রতীক-প্রায়, এই বাজার-বিশ্বে বড়ই বেমানান, অপ্রাসঙ্গিক রূপকথার এক মানুষ। মানুষের মতোই অনেকখানি মানুষ হওয়ার এই তবে বিনিময়মূল্য, ‘একেই কি বলে সভ্যতা’, বিশ্বায়ন? এতকালে তিলতিল গড়ে ওঠা মানবের সত্তা-স্বভাব বলি দিয়েই যাঁর এমন বিশ্বজোড়া বাড়-বাড়ন্ত? ‘মানুষ আর সেই মানুষ নাই’ তাই কি?

No comments

Powered by Blogger.