পোশাকশিল্প-‘তিন হাজার টাকা’ by শাহদীন মালিক

সংবিধান নিয়ে আলোচনায় এখন অনেকেই বলছেন বা প্রশ্ন তুলছেন যে এতকাল পর ‘সমাজতন্ত্র’ কথাটিই সংবিধানে কীভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সমাজতন্ত্র তো উঠে গেছে সারা বিশ্ব থেকে। উনি মারা গেছেন। অতএব উনাকে (সমাজতন্ত্রকে) নিয়ে টানাহেঁচড়া অবাস্তব।


অর্থাৎ পোশাকশিল্প শ্রমিকদের মজুরি তিন হাজার টাকাই সই! (সূত্র: প্রথম আলো, ২৬ জুলাই) এখন ধনতন্ত্রের যুগ। দুপক্ষ আলাপ-আলোচনা করে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হবে, সেটাই ঠিক। বাংলাদেশে শোষণ নেই। শোষণটোষণ সমাজতন্ত্রের অচল কথা। পোশাকশিল্পমালিকদের যদি তিন হাজার টাকার বেশি পারিশ্রমিক দিতে হয় শ্রমিকদের তাহলে ফ্যাক্টরি চলবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় উৎস ধ্বংস হয়ে যাবে, লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে, অশান্তি-হানাহানি বাড়বে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আরও আছে, সংখ্যার হিসাব। কী কী যেন বলা হয়—একসময় ছিল ৬০০ টাকা। তারপর বেড়ে হলো ৯০০ টাকা। তারপর এক হাজার ১০০-র কিছু বেশি এবং সর্বসাকুল্যে এক হাজার ৬০০ টাকা বা তারও কিছু বেশি।
‘আর জানেন না। যারা শুরু করে, তারাই এক হাজার ৬০০ টাকা তারও কিছু বেশি পায়। অভিজ্ঞজনেরা অনেকে সাত-আট হাজার থেকে শুরু করে ভালো ফ্যাক্টরিতে ১৫ হাজার বা তারও বেশি পায়।’
তার পরও আমার তথ্যসমৃদ্ধি আরও ব্যাপকতর করা হয় অনেকটা এক নিঃশ্বাসেই ‘ওই কালো গাড়িটা পছন্দ হয়ে গেল। এক কোটি ১০ লাখের কমে কোনোমতেই দেবে না। কী আর করি। নিয়ে নিলাম।’ এ কথা ও কথার পর ‘ভাই, ভাবছি এবার ছেলেমেয়েদের নিয়ে তিন সপ্তাহ আমেরিকা ঘুরে আসব। এই তো দুই দিন আগে স্পেন থেকে এলাম। ওদের নিয়ে তো আর যাওয়া হয় না। সময় পেলে ভাবছি তিন দিনের জন্য হলেও কানাডা ঘুরে আসব।’
সমাজতন্ত্র-শোষণ আসলেই সেকেলে কথাবার্তা।

২.
প্রায় দুই দশক ধরেই দেখছি বিজেএমইএ হাচ্চু মারলেই সরকার কাঁপে! এতে তো আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছুই নেই। বিজেএমইএ বলছে, এর বেশি আর দেওয়া যাবে না। সব ধরনের শুল্ক থেকে ছাড় পাই, গ্যাস-বিদ্যুৎ পাই, ইপিজেড পাই, যেখানে কোনো শ্রম আইন নেই, ব্যাংক থেকে লোন পাওয়ার সামান্য সুযোগ-সুবিধায় মন ভরে না, বহু বছর তাই নিজেরাই ব্যাংকমালিক হয়ে গেছি (বাধ্য হয়ে), আর নির্বাচন এলে ডজন দুয়েক আসন তাদের জন্য বরাদ্দ না থাকলে কেমনে চলবে দেশ।
দেশকে ডলার-পাউন্ডে ছয়লাব করে দিচ্ছেন। অতএব তিন হাজার টাকার এক পয়সা বেশি দেওয়া অসম্ভব?
সবই ঠিক, হক কথা।
ভাঙচুর আজকাল হচ্ছে প্রায় অহরহ। একটা ভাঙচুর হলে শ-পাঁচেক শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি, এমন ভাঙচুরের ঘটনা কেউ জানেন কি? গত দুই দশকের শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য কোনো মালিক কি জেলের ভাত খেয়েছে?
খাবে না, এটা বলাবাহুল্য।
একটা ‘রাফ’ হিসাব।
এখন ঢাকা আর কাশিমপুর জেলে প্রায় ২০০-র মতো ‘কনডেমনড প্রিজনার’ আছে। অর্থাৎ বিচারিক আদালত যাদের দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল বাধ্যতামূলক। হাইকোর্টে আপিলে এদের শতকরা পঁচাত্তর ভাগেরই নিজস্ব অ্যাডভোকেট নেই। সরকার তাদের উকিল দিচ্ছে। আর অন্যদিকে দুর্নীতি মামলায় যারা দোষী প্রমাণিত হয়ে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন, তাঁদের দু-একজনও কি এখনো জেলে আছেন?
আমরা একটা সম্পূর্ণ শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছি। অতএব তিন হাজার টাকা মজুরি পেলে পোশাকশ্রমিকদের উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করা দরকার। আশা করব, নতুন মজুরি নির্ধারণের পর পোশাকশ্রমিকদের জন্য ‘ওপেন এয়ার কনসার্টে’র ব্যবস্থা হবে।

৩.
২৬ জুলাই প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ‘উদ্ধৃতি’ অংশে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর একটা উদ্ধৃতি আছে—‘বেসরকারি খাত সরকারি খাতের চেয়েও বেশি দুর্নীতিবাজ।’
কথাটা আমলে নেওয়া দরকার। এটা অনস্বীকার্য যে ফ্যাক্টরির মালিকদের পথে-ঘাটে ঘুষ দিতে হয়। বন্দরে কাঁচামাল এনে সে কাঁচামাল খালাস করা থেকে শুরু করে ঢাকার ফ্যাক্টরিতে এনে পোশাক বানিয়ে এবং সেটাকে আবার বন্দরের জাহাজে তোলা পর্যন্ত কতটা ঘাটে যে ঘুষ দিতে হয়, তার হিসাব তারাই ভালো জানে।
মালিক সংগঠনের চোটপাট সব শ্রমিকের ওপর।

৪.
আমার ধারণা, পোশাকশ্রমিকেরা তিন হাজার টাকা মানবে না। সংখ্যার হিসাবে যাব না। কিছু তত্ত্ব কথা বলি। বলাবাহুল্য তাই দায়ভার আমার না, কিছু বইপত্তর ঘেঁটে যা বুঝেছি তা-ই বলছি।
১৯২০-এর দশকে হুগলি নদীর চারপাশে সে সময়ের সারা বিশ্বের অন্য সব জায়গার তুলনায় সে আমলের পাটশিল্পে যে শ্রমিকেরা কাজ করত, তাদের মোট সংখ্যা সে সময়ের ইউরোপ-আমেরিকার যেকোনো একক শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকের সংখ্যা থেকে ছিল বেশি। হুগলি নদীর তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা পাটশিল্পের শ্রমিক ছিল হাজার হাজার, কিন্তু তৎকালীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় এত শ্রমিক মোটামুটি এক জায়গায় থাকা সত্ত্বেও বড়সড়ো কোনো শ্রমিক আন্দোলন গড়ে ওঠেনি।
কংগ্রেস-মুসলিম লীগ কোনো বৃহৎ দলে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার প্রতিফলন ঘটেনি। ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশ স্বাধীন করা ছিল ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া স্থান পায়নি।
এখন আসি কারণের কথায়। এত হাজার হাজার শ্রমিক কিন্তু তারা কেন কিছু করতে পারল না। কারণ হলো, সে সময়ের পাটশ্রমিকেরা যদিও পাটশিল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ করত, তথাপি মনে-প্রাণে তারা নিজেদের কৃষক ভাবত? অর্থাৎ কোলকাতা-হুগলিতে আসত অল্প সময়ের জন্য, কিছু বাড়তি রোজগারের আশায়। টাকা-পয়সা কিছু জমলে আবার গ্রামে ফিরে যাবে। ঋণটা শোধ করবে, জমি বন্ধকমুক্ত করবে, দুটো গরু কিনবে এবং আবার কৃষিকাজে মনোযোগী হবে। কৃষিতে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জমত না। শ্রমিক হিসেবেই পাঁচ, সাত, দশ, পনেরো বছর কেটে যেত। কিন্তু তা সত্ত্বেও মনে-প্রাণে সে কখনো শ্রমিক হয়নি। ফলে শ্রমিক হিসেবে তার দাবি-দাওয়ার প্রতি সে ছিল অমনোযোগী। শ্রমিক-আন্দোলনে শরিক হওয়ার মনমানসিকতা তার গড়ে ওঠেনি।
নিকট-অতীতের নারায়ণগঞ্জের আদমজী বা খুলনার পাটশিল্পের শ্রমিকেরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং অন্যান্য কারণে সম্ভবত নিজেদের নিতান্ত শ্রমিক ভাবত না। কিছুটা সরকারি বা সুবিধাভোগী ভাগ তাদের ছিল বা সে ধরনের মনমানসিকতা তৈরি করা হয়েছিল, তাদের ভেতরে যাতে তারা আন্দোলন-ফান্দোলন না করে।
আশির বা নব্বইয়ের দশকে যেসব মহিলা গ্রাম থেকে ঢাকায় বা শহরে এসে পোশাকশিল্পে কাজ শুরু করেছিল, তারাও আমার ধারণা, নিজেদের স্বল্পকালের শ্রমিক ভাবত। কিছু টাকা-পয়সা জমলে গ্রামে ফিরে গিয়ে বিয়ে-শাদি করে ঘর-সংসার করবে। যৌতুকের টাকা জোগাড় করাও পোশাকশিল্পে কাজ করার একটা কারণ ছিল, অনেক ক্ষেত্রেই।
অল্প কথায় বড় কেচ্ছা সারছি। ১৯২০ থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত কৃষি বা গ্রামে ফিরে যাওয়ার সে মনমানসিকতা বা স্বপ্ন, সেটা এ শতাব্দীর আশুলিয়ার গার্মেন্টস শ্রমিকদের আর নেই। অন্তত আমার তা-ই ধারণা। তারা ঢাকাতেই থাকবে (সেটা রামপুরা, মিরপুর, আশুলিয়া বা ইপিজেড এলাকা যেখানেই হোক না কেন)। আর যেকোনো অন্য চাকরিজীবীর মতো ঈদে-পরবে গ্রামে যাবে আত্মীয়স্বজন, বাবা-মা, ভাই-বোনদের সঙ্গে সময় কাটাতে। কিন্তু ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরে আসবে।
আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা যেমন দুই-চার-পাঁচ বছর বিদেশে সবকিছু সহ্য করে প্রতিদিন ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করে গাদাগাদি করে থাকে। পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা সেটা আর করবে না, অতীতের পাটশিল্পের মতোই প্রবাসী শ্রমিকেরা সবকিছু সহ্য করে। কারণ, তারাও গ্রামে (অর্থাৎ দেশে) ফিরে আসবে। প্রবাস-জীবন ক্ষণিকের।
পোশাকশিল্পের শ্রমিকের জীবন এখন তার সারা জীবন। এই কাজ সে সারা জীবন করবে। তার মনমানসিকতা বদলেছে। সে আর সহজে ছাড় দেবে না।
মালিক-রাজনীতিবিদ-পুলিশ সবাইকে এটা উপলব্ধি করতে হবে।

৫.
‘ক্রসফায়ার’ দিয়ে যেমন অপরাধ দমন করা যায়নি বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ক্রমান্বয়ে ভাড়াটে বাহিনীতে পরিণত হচ্ছে, তেমনিভাবে শ্রমিকদের দাবিদাওয়াকে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’, ‘দেশ অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত’ ইত্যাদি ভাবে আখ্যায়িত করার নিবুুর্দ্ধিতায় লিপ্ত না হয়ে শোষণের মাত্রা কমাতে হবে। তিন হাজার টাকায় দু-চার মাস সময় হয়তো ‘কেনা’ যাবে। ওই পর্যন্তই।
বড় পোশাকশিল্প আছে অথচ মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধী হবেন না, বুকে হাত দিয়ে কয়জন পোশাকশিল্পমালিক বলতে পারবেন। পারতেন, যদি আপনার শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করতেন—একই বেলায় মাছ-মাংস দিয়ে পেটপুরে শেষবার কখন খেয়েছিলে মনে পড়ে কি?
আমার হিসাবে, কোরবানির ঈদ এখনো মাস চারেক দূরে। তিন হাজার টাকা মাস হিসাবে একজন হেলপার আগামী চার মাসে কয়বার মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে তৃপ্তিতে ঢেঁকুর তুলতে পারবে।
যারা বলে, সংবিধানে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটা রাখা যাবে না, তারা নাকি রাজনৈতিক নেতা।
শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট।

No comments

Powered by Blogger.