লাশ হচ্ছে শত শত জেলেঃ নিরাপত্তা দিতে পারছে না প্রশাসন

নিরাপত্তার অভাবে মাছধরা পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে উপকূলীয় জেলেরা। প্রতি বছর মাছ ধরতে গিয়ে সাগরে ভেসে যাচ্ছে শত শত জেলে। ঝড়ঝঞ্ঝার কবলে পড়ে ট্রলারডুবিতে বহু জেলের সলিল সমাধি হলেও এ সম্পর্কে সরকারি দফতরে কোনো হিসাব নেই।

এমনকি ট্রলার দেখভালকারী প্রতিষ্ঠান মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টও (এমএমডি) খবর রাখে না কবে, কোথায় ট্রলার ডুবে কত জন জেলে মারা গেছে। অভিযোগ আছে, এ-সংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যান সংস্থাটির হাতে নেই। সাগরে যাওয়ার আগে ট্রলারের ফিটনেস পরীক্ষা একটি অনিবার্য বিষয়। এ ছাড়া বয়াসহ বিভিন্ন জীবনরক্ষাকারী উপকরণ নেয়াও জরুরি। এসব দেখার জন্যই এমএমডি। জানা গেছে, নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে এমএমডি চূড়ান্ত উদাসীন। উল্টো জেলেদের কাছ থেকে নগদ দক্ষিণা নিয়ে ভাঙা এবং প্রায় অকেজো ট্রলারকে ফিটনেস সার্টিফিকেট দিচ্ছে এমএমডি। স্বভাবতই এ ট্রলারগুলোই সাগরে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিপাকে পড়ে। কিন্তু কার গোয়াল কে দেয় ধোঁয়া! এদিকে সাগরে জেলেদের নিরাপত্তায় নামমাত্র যে কোস্টগার্ড ও টহলদার নৌবাহিনী রয়েছে তা কেবলই উপকূলকেন্দ্রিক। গভীর সাগরে কোথায় কী হচ্ছে তা তাদের দায়িত্বের আওতায় পড়ে না। অর্থাত্ পর্যাপ্ত নজরদারি বলে যা বোঝায় মাছ শিকারি জেলেদের জন্য তা অনুপস্থিত। ফলে ফি-বছর ট্রলার ডুবছে, জেলেরা ভেসে যাচ্ছে লাশ হয়ে। পাশাপাশি ভেসে যাচ্ছে তাদের অভাবী পরিবার। সাগরের লোনাপানি আর চোখের পানি মিশে হাহাকার জিইয়ে রাখছে উপকূলীয় জেলেপল্লীতে। সেই আর্তনাদ শোনার কেউ নেই।
তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন জেলেদের নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। ২০০৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে সাগরে পাঁচ শতাধিক ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে। এতে মারা যায় শত শত জেলে, তার পরও তাদের নিরাপত্তার বাড়তি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। এমএমডির কানেও পানি যায়নি। এরপর ২০০৭ সালে সিডরের জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় কলাপাড়ার ৩০টি মাছ ধরার ট্রলার সাগরে ডুবে যায় পাঁচ শতাধিক জেলেসহ। এখনও নিখোঁজ রয়েছে তাদের কয়েকজন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও জেলেদের ওপর মাঝে মধ্যেই চড়াও হয় জলদস্যুরা। তাদের তাণ্ডবে এ পর্যন্ত অসংখ্য জেলে সাগরে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে। এ ছাড়া প্রায়ই লুট হচ্ছে মাছ ধরার জাল, মাছ, জ্বালানি এবং নগদ টাকাসহ সবকিছু। অনেক সময় ট্রলারেরও হদিস মেলে না। কোস্ট গার্ড এবং টহলদার নৌবাহিনী এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। আশ্চর্যের বিষয়, ঝড়ঝঞ্ঝার সময় রাতেরবেলা ট্রলার নিয়ে কূলে ফিরতে দিকনির্দেশক বাতির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। সাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে যাতে ট্রলারডুবির ঘটনা আরও বেড়ে না যায় সে জন্য জেলেরা কুয়াকাটায় ১৫০ ফুট উচ্চতার সিগন্যাল বাতির দাবি করে আসছিলেন। এখানে আন্দারমানিক নদীর দু’পাড়ে দুটি সিগন্যাল বাতি স্থাপনের জন্য তারা আবেদন করলেও কোনো ফল হয়নি। গভীর সাগর থেকে তড়িঘড়ি মত্স্যবন্দরে ফেরার জন্য এ পথটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসন সব জেনেও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। এ অবস্থায় নিয়তির ওপর ভরসা করে জেলে-জনপদে একযোগে বাড়ছে অভাব ও আতঙ্ক।
বাংলাদেশের সব জেলে পল্লীতেই এখন নেমে এসেছে দুর্দশার ছায়া। নদী-জলাশয় শুকিয়ে যাচ্ছে, দূষণাক্রান্ত হয়ে নির্বংশ হচ্ছে মাছসহ তাবত জলজপ্রাণী। জাল আর জল একদিন যাদের জীবিকা জুগিয়েছে তারা এখন ধুঁকছে অনাহার-অর্ধাহারে। এর ওপর যদি উপকূলীয় জেলেরা নিরাপত্তার অভাবে সাগরে লাশ হয়ে যায় ট্রলারডুবিতে, জলদস্যুদের আক্রমণে, তাহলে দেশের মাছের জোগান দেবে কারা? নিরাপত্তার কম-বেশি ব্যবস্থা থাকলেও স্রেফ প্রশাসনিক গাফিলতিতে কত দিন উপদ্রুত থাকবে জেলেরা? এসব প্রশ্ন নিয়ে সরকার তথা ভাবতে হবে প্রশাসনকে। এমএমডিকে দায়িত্বশীল করার লক্ষ্যে কঠোর জবাবদিহিতার মুখোমুখি করতে হবে। টহলদারি বাড়াতে হবে সাগরে। ট্রলারে সুলভে সরবরাহ করতে হবে জীবনরক্ষাকারী উপকরণ। উপরন্তু সাগর থেকে মত্স্য বন্দরে ফিরতে জেলেদের দাবি অনুসারে স্থাপন করতে হবে দিকনির্দেশক বাতি। সুন্দরবনসহ অন্যান্য অঞ্চলের জলদস্যু দমন করতে বিশেষ বাহিনী গঠনের বিষয়টিও ভেবে দেখা জরুরি। যাতে মোকাবিলা করার মতো দুর্ঘটনায় জেলেদের সাগরে ভেসে যেতে না হয় এবং উপার্জনক্ষম মানুষটি হারিয়ে অভাবের পাকে বিপর্যস্ত না হয় অগুনতি সংসার। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার উপকূলীয় জেলেদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পিছপা হবে না।

No comments

Powered by Blogger.