চারদিক-যুদ্ধ নাকি শান্তির জন্য! by এম এম খালেকুজ্জামান

আগামীকাল ৬ আগস্ট। তারিখটি শুনলে অনেকেই ফিরে যাবেন ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্টে। এখন সবাই জানে কী ঘটেছিল সেদিন। আবার একটু মনে করিয়ে দেওয়া যাক। ৬ আগস্ট ভোরবেলা। হিরোশিমার রঙিন ফড়িং কিংবা ঘুমপ্রিয় উচ্ছল শিশুরা তখনো ঘুম থেকে জেগেছে কি জাগেনি।


তেমন সকালে যাবতীয় চলমানতাকে স্থবির করে দিয়ে, আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে বিস্ফোরিত হলো মানব ইতিহাসের ভয়ংকরতম অভিশাপ পারমাণবিক বোমা। সভ্যতা প্রত্যক্ষ করল ভয়াবহতম নরমেধযজ্ঞ। ওই দিন সকাল আটটা ১৬ মিনিটের আগের ও পরের ইতিহাস সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ সেই ক্ষণ থেকে পৃথিবী নামের এই গ্রহ পারমাণবিক বোমার অভিজ্ঞতায় বিপর্যস্ত হয়। হিরোশিমার যুদ্ধবিরোধী জাদুঘরে রক্ষিত আটটা ১৬ মিনিটে থমকে থাকা ঘড়ি মানবজাতির সামনে নিয়ে আসে ইতিহাস থমকে থাকার ইতিবৃত্ত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই যুদ্ধের জয়-পরাজয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতার চেয়ে যুদ্ধের পক্ষগুলো বিপক্ষ শিবিরকে বীভৎসতা ও প্রতিহিংসার মাধ্যমে ঘায়েল করার দিকেই বেশি নজর দেওয়া শুরু করে। ফলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আইন এবং কনভেনশনগুলো পদাবনত করে হত্যা ও জিঘাংসার রাজনীতি কায়েম হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন মিত্রবাহিনী কার্যত ভয়েই ছিল—পাছে অন্য কেউ তাদের আগেই ভয়ংকর কোনো বোমা বানিয়ে ফেলে! আইনস্টাইন যখন জানতে পারেন জার্মান পরমাণুবিজ্ঞানী অটোহান ইউরেনিয়াম পরমাণু বিদীর্ণ করতে সক্ষম হয়েছেন (২২ ডিসেম্বর, ১৯৩৮) তখনই তিনি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে পত্র মারফত পারমাণবিক বোমা বানানোর অনুরোধ করেন। এই সুযোগই গ্রহণ করে মিত্রপক্ষ। হিটলার প্রবর্তিত নাৎসিবাদের বিস্তারের কারণে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, সুইজারল্যান্ডত্যাগী ম্যাক্স বর্ন, জেমস ফ্র্যাঙ্ক, জিলার্ড, ভিগনার প্রমুখ জাদরেল বিজ্ঞানীর সমন্বয়ে পরিচালিত হয় ‘প্রজেক্ট ম্যানহাটন’। এর উদ্দেশ্য ছিল দুটো—পরমাণু চুল্লি ও অ্যাটমিক বোমা আবিষ্কার। যথাক্রমে ফেমি ও ওপেনহাইমার প্রকল্প দুটোর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এর ধারাবাহিকতায় ফেমি নগণ্য ক্ষমতার একটি পারমাণবিক চুল্লি এবং ওপেনহাইমার পারমাণবিক বোমা আবিষ্কার করে ফেলেন।
‘হাজার সূর্যের ঔজ্জ্বল্য যদি মধ্যাকাশে উদ্ভাসিত হয় সেটা কেবল শক্তিমানের সাথেই তুল্য’—সেই বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ দেখে এমন বোধেই আচ্ছন্ন ছিলেন প্রজেক্ট ম্যানহাটনের বিজ্ঞানীরা। অন্যদিকে, হাইসেনবার্গের নেতৃত্বাধীন জার্মানির প্রকল্পটি মোটেই হালে পানি পাচ্ছিল না।
এরই মধ্যে ওপেনহাইমারের নেতৃত্বে একটি কমিটি দায়িত্ব দেওয়া হয় সম্ভাব্য কোন কোন শহরে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো যায় তার তালিকা তৈরি করতে। তালিকায় কোকুরার অস্ত্রাগার, কিয়োটো, ইয়োকোহামা ও নাগাসাকি শহর নির্বাচন করা হয়। শিয়রে বিষাক্ত ফণা তোলা সাপ নিয়ে যেমন শান্ত থাকা যায় না, তেমনি শত্রু ঘায়েলের মোক্ষম বোমাটিও মিত্রবাহিনীকে স্থির থাকতে দেয়নি।
পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের পরপরই বিজ্ঞানী জেমস ফ্র্যাঙ্ক ও তাঁর সহযোগীরা এ বোমার বিষময় ফল ও পরবর্তী সময়ে এর যথেচ্ছ প্রসারসংক্রান্ত সতর্কবাণী কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। চার্চিল ও ট্রুম্যান রাষ্ট্রনায়কদ্বয় ফ্র্যাঙ্ক-রিপোর্টকে পাত্তা দেননি। আইনস্টাইন নিজে পত্রমারফত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে এই সভ্যতাসংহারী অস্ত্র ব্যবহার না করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনিও প্রত্যাখ্যাত হন।
অবশেষে ম্যানহাটন প্রজেক্ট তৈরি করল পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক বোমাটি। চার হাজার কেজি ওজনের সেই ভয়াল বিস্ফোরকের নাম দেওয়া হলো ‘লিটল বয়(!)’। ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’-এর আবিষ্কার ‘লিটল বয়’-এর সুষ্ঠু প্রসবের জন্য নরওয়ের একজন প্রখ্যাত আবহাওয়াবিদকে দায়িত্ব দেওয়া হয় কোন দিন কোন শহরে বোমার সফল বিস্ফোরণ ঘটানো যায় তা ঠিক করতে। অতঃপর ৬ আগস্ট এল ইতিহাসের পাতায় কালিমা লেপন করা সেই দিন। ‘বি-২৯ সুপারফোর্টেস’ নামের বিমান (এনোলা গে) নিয়ে পাইলট কর্নেল পল টিবেটস কথিত ছোট্ট বালককে প্রসব করার জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের তিনিয়ান ঘাঁটি থেকে উড়াল দেন। স্থানীয় সময় সকাল ঠিক আটটা ১৬ মিনিটে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই হাজার ফুট ওপরে ইতিহাসের প্রথম পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে মুহূর্তেই প্রাণোচ্ছল রমণীয় হিরোশিমা পরিণত হলো গলিত লাভার শহরে। হলুদ গাঢ় ধোঁয়া ক্রমেই কয়লা রং ধারণ করে তাৎক্ষণিক প্রায় ৬৭ হাজার নাগরিককে পোড়া কয়লায় পরিণত করে।
বেঁচে যাওয়া এক জাপানি পরে বলেছিলেন: ‘সকাল সকাল যেন কোনো চায়নিজ ড্রাগনের শত হাত বিস্তৃত আগুনের জিহ্বা নেমে এসেছিল আমার শহরে।’ বোমার আঘাতে শহরের দুই-তৃতীয়াংশ সম্পূর্ণ কঙ্কালে পরিণত হয়। বিস্ফোরণকেন্দ্রের তিন মাইলের মধ্যে ১৩ কিলোটন টিএনটি সমপরিমাণ ক্ষমতাসম্পন্ন ধ্বংস সাধন করে। এর ঠিক তিন দিন পর নাগাসাকিতেও সাড়ে চার হাজার কেজির আরেকটি বোমা ফেলে ৪০ হাজার মানুষকে লাশে পরিণত করা হয়।
পাইলট পল টিবেটস বিমান থেকে বোমা ফেলার কয়েক সেকেন্ড পর হিরোশিমার যে কল্পনাতীত ভয়ংকর দৃশ্য অবলোকন করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে তিনি উন্মাদে পরিণত হন এবং অকালমৃত্যু তাঁকে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়।
বিশ্লেষকেরা বলেন যে যুদ্ধে জর্জরিত জাপান রসহীন খোসায় পরিণত হয়েছিল। এই দুটি মহাবিস্ফোরণের প্রয়োজন ছিল না। এমনিতেই বশ্যতা স্বীকার করে নিত জাপান। ভয়ংকর সেই বিস্ফোরণের তেজস্ক্রিয়তায় যে কেবল তখনকার প্রজন্মই মৃত্যুবরণ করেছে বা বিকলাঙ্গ, স্নায়ুবৈকল্যের শিকার হয়েছে তা নয়। উত্তর প্রজন্মও এর ভয়াল প্রতিক্রিয়ার শিকার। তার জ্যান্ত প্রমাণ আমরা দেখতে পাই নোবেল লরেয়ট সাহিত্যিক কেনজাবুরোওয়ের যুদ্ধদিনের রচনা ‘হিরোশিমা নোটস’ থেকে। বিস্ফোরণের প্রায় দেড় যুগ পর জন্ম নেওয়া তাঁর ছেলে হিকারি ‘ক্রনিয়াল হার্নিয়া’ নিয়ে জন্ম নেয়। তাঁকে বাঁচানোর জন্য মস্তিষ্কে জটিল অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। পরবর্তী সময়ে হিকারি মস্তিষ্কের ত্রুটি নিয়েই বেড়ে ওঠেন। এমন অনেক হিকারিই পরবর্তী সময়ে অসম্পূর্ণ মানুষ হয়ে পারমাণবিক বোমার ফলাফল বয়ে বেড়াচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.