বহে কাল নিরবধি-শেষ দেখতে সময় লাগবে by এম আবদুল হাফিজ

৩০ বছরের একচ্ছত্র শাসনের পর ক্ষমতাচ্যুতির সময় তাঁর হতদরিদ্র দেশের কাছে প্রাপ্ত পারিশ্রমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাঁচাতে পেরে স্বৈরশাসক হোসনি মুবারক অবশ্য ফুরফুরে মেজাজেই থেকে থাকবেন। এদিকে আগামী দিনগুলোতে অবাধ স্বাধীনতা উপভোগের আশায় রাজপথে সফল একটি 'বিপ্লব' অনাগত মুক্তি ও অন্তত একটি চলনসই গণতন্ত্রের জন্য মিসরীয়দের উন্মাতাল করেছিল।
কিন্তু তাদের সে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে কি? তারা তো ধরেই নিয়েছে যে মিসরবাসী তাদের সর্বশেষ এবং 'অপরিহার্য' ফারাওয়ের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে।
কিন্তু মিসরে এ সময় আসেল কে ধারণ করে আছে ক্ষমতার দণ্ড? ১৮ বছর ধরে মুবারকের গোয়েন্দাপ্রধান জেনারেল ওমর সুলাইমানকে মুবারক মাত্র কয়েক দিন আগেই তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি দিয়েছিলেন। যদিও সুলাইমান মুবারকের মতোই নির্যাতক বলে পরিচিত। রাজবন্দিদের নির্যাতন করার ব্যাপারে সুলাইমানের কুখ্যাতির অন্ত ছিল না। কিছুদিন আগেও পাশ্চাত্যের নেতৃত্ব মুবারকের এই প্রধান নির্যাতককে তাঁর উত্তরাধিকারী ভাবছিল। কিন্তু অল্প দিনেই ঘটনাপ্রবাহের বিবর্তনে তাঁর প্রভুর মতো সুলাইমান এখন নিজেই দায়ে পরিণত হয়েছেন। ক্ষমতার উত্তেজক খেলার ময়দানে যদিও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন নিবিড়ভাবে।
কিন্তু একপর্যায়ে তাঁর অধীন বাহিনী তাঁর আদেশ মানতে অগ্রাহ্য করার আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সশস্ত্রবাহিনীপ্রধান ফিল্ড মার্শাল তানতাবি বিপ্লব চলাকালীন এক মধ্যরাতে 'শক্ত একটি ধাক্কায়' তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করেন। কায়রোর পটভূমি রচনাকারী পিরামিডগুলো মিসরীয়দের হাজার বছরের দাসত্বের সাক্ষী। লাখ লাখ মিসরীয় ক্রীতদাস আমৃত্যু তাদের শ্রম দিয়ে এগুলোকে দাঁড় করিয়েছিল। সম্প্রতি নিছক শান্তিপূর্ণ একটি বিপ্লবের মাধ্যমে মিসরীয়দের অর্জন ছিল অসাধারণ। কিন্তু সিএনএনের একজন ভাষ্যকারের মতে, 'সাফল্যের পর একটি আনন্দ চঞ্চল উত্তেজনার মধ্যে ওই একই প্রশ্ন জেগে থাকে। অতঃপর কী?'
'স্বাধীনতা' অভিব্যক্তিটির সঙ্গে যা কিছু জড়িয়ে, মিসরীয়রা তার সব কিছুর আস্বাদন চায়। তারা শেকল ভাঙতে চায়। শেকলের কষ্ট ভুলতে চায়। স্বভাবতই এ সব কিছু রাতারাতি অর্জিত হবে না। অর্জিত হবে না একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই বলি বা ব্যবস্থাপনা কাঠামোই আখ্যায়িত করি, তার অস্তিত্ব ছাড়া। তা না থাকলে একটি নৈরাজ্য অবশ্যম্ভাবী। বিপ্লব মাত্র ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার পরই প্রেসিডেন্ট মুবারক তাঁর অনুগতদের সমভিব্যহারে একটি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করতে বাধ্য এবং তাতে এয়ার মার্শাল শফিককে প্রধানমন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়েছিল।
ফলে সামরিকভাবে প্রাধান্যপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ প্রথমেই পার্লামেন্টের উভয় কক্ষকেই ভেঙে দেয় এবং সংবিধানকে স্থগিত করে। কিন্তু এই কর্তৃপক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে মাত্র ছয় মাসের জন্য ক্ষমতায় থাকার এখতিয়ার দেয়। এর অর্থ এই যে, এই সময়কালের মধ্যেই পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। মাত্র ১০ দিনের মধ্যে একটি কমিশনকে সংবিধানে কোনো প্রয়োজনীয় সংশোধনের জন্য প্রস্তাব পেশ করতে হবে। অতঃপর সংশোধিত সংবিধানটি গণভোটে দেওয়া হবে দুই মাসের মধ্যে। রাজপথে বিক্ষোভকারীদের তৎপরতা থিতিয়ে আনতে মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। অব্যাহতি নিয়ন্ত্রণের তালিকা প্রণীত হয়েছে মুবারকযুগের দুর্নীতির দায়গ্রস্ত কুখ্যাত ব্যবসায়ী ও আমলাদের জন্য।
এসব পদক্ষেপ এখনকার একটি জাগ্রত জনগণকে কতখানি সন্তুষ্ট করতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। তাহরির স্কয়ার এবং পরবর্তী সময়ে অসংখ্য যেসব ক্ষুদ্র তাহরির স্কয়ারের উৎপত্তি ঘটেছিল, সেসবে উত্থিত দাবিগুলো যা এখনো অব্যাহত আছে, সেসব পূর্ণ করার কোনো প্রতিশ্রুতি কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আসেনি। যেসব প্রতিশ্রুতিই বা এ পর্যন্ত পূর্ণ হয়েছে, সেসব এক ধরনের দায়সারা এবং গোঁজামিল মিসরীয়দের বহুদিনের জমাটবাঁধা অভিযোগ বা অসন্তোষের সেসব কোনো স্থায়ী বা কার্যকর সমাধান নয়।
সুইজারল্যান্ড সে দেশে সঞ্চিত মুবারক এবং তাঁর পরিবারের সব সম্পদ ও আর্থিক লেনদেন ফ্রিজ করেছে। সুইজারল্যান্ড ইতিপূর্বে বেন আলী ও তাঁর পরিবারের সম্পদও ফ্রিজ করেছিল। ইন্টট্রে ব্রাসেলসের ইইউ দপ্তর বিষয়টি সম্পর্কে সজাগ এবং প্রত্যাশিতভাবেই তাঁদের সম্পদের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। মুদ্রা ও সম্পদ পাচার যুক্তরাষ্ট্রে আরো কঠিন। কিন্তু মুবারকের সেখানে সম্ভাব্য সম্পদ পাচার সম্পর্কে দেশটির নীরবতা বেশ বিস্ময়কর। এ ছাড়া বিপ্লবোত্তর দেশগুলো থেকে বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সব আন্তর্জাতিক চুক্তি রক্ষিত হবে এবং প্রদত্ত কমিটমেন্ট থেকে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো সরে আসবে না। পাশ্চাত্যের সম্ভবতই এসব প্রতিশ্রুতি ভালো লেগেছিল। মুবারকের পতনে ইসরায়েলের আস্থায় যে চোট লেগে থাকবে তারও উপশম এ প্রতিশ্রুতিমালার মধ্যেই নিহিত। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে উভয়পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে ইসরায়েলের ওপর যে অব্যাহত চাপ রয়েছে, এমন প্রতিশ্রুতিতে ইসরায়েলেরও কিছু দম মিলবে এবং নতুন পারিপাশ্বর্িকতায় নীতি পুনর্বিন্যাসে ইসরায়েলও কিছু সময় পাবে।
আরো কিছু দিন ও সপ্তাহের প্রয়োজন এ কথা অনুধাবন করতে, মিসরীয় বিপ্লব আসলেই কোন দিকে যাচ্ছে। সবাই নিজেদের আঙুলগুচ্ছ আড়াআড়ি রেখেছে শুধু দেখতে যে কোথাকার পানি কোথায় গড়ায়। সবাই আশা করে আছে যে 'সামরিক কাউন্সিলে' ১৮০ দিন এক যুগে গড়াবে না_যেমনটা পাকিস্তানের জিয়াউল হকের বেলায় নব্বই দিনের পরিসমাপ্তি কখনো হতো না।
এটাই প্রথম নয় যে, মিলিটারি রাজপথ রাঙানো জনগণের আত্মত্যাগকে ছিনতাই করেছে। পাকিস্তানের চার-চারটি সামরিক অভ্যুত্থান জনগণের সমর্থনে প্রথমে জনপ্রিয় থাকলেও অনেক দেরিতে অনুভূত হয়েছিল, জেনারেলরা প্রথম তাদের ভুল বোঝালেও আসলে সেগুলো সংঘটিত হয়েছিল জনতার আকাঙ্ক্ষা নয়, তাদের নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য। ১৯৬৮ ও ১৯৭৭ সালের অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছিল রাজপথে দ্রুত বিস্তৃত নৈরাজ্য ঠেকাতে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান এবং ১৯৯৯ সালে পারভেজ মোশাররফ বুঝেছিলেন যে বেসামরিক কর্তৃত্ব তাঁদের অ্যাকশনের আগেই তাঁদেরকে প্রিএম্ট করার চেষ্টা করছিল। বাংলাদেশে এরশাদের অবস্থাও ছিল প্রিএম্পশনের মুখে পড়ার মতো। তাঁদের সবারই মুখোশ ছিল ত্রাতার।
মিসরীয় মিলিটারির পাকিস্তানি বা বাংলাদেশি মিলিটারির সঙ্গে বেশ কিছুটা সাদৃশ্য আছে। মিসর তিন যুগ ধরে মার্কিনিদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। এই মৈত্রীর চাবিকাঠি ছিল মিসরীয় মিলিটারির হাতে। বাংলাদেশের কথা বাদ দিলে পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা তৈরির নেশায় নব্বইয়ের দশক ধরে মার্কিনিদের কাছে উপেক্ষিত ছিল। তবু পাকিস্তানিরা এককালের 'গড়ংঃ ধষষরবফ ধষষু' হিসেবে মার্কিনিদের নানা উপঢৌকন যেটুকু পেত, দেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নতিকল্পে অবদান রাখার স্থানে যে টাকা যেত বিভিন্ন ছলছুতোয় জেনারেল ও তাঁদের প্রিয়জনদের পকেটে; এভাবেই পাকিস্তানে সেনাকল্যাণ বা ফৌজি ফাউন্ডেশন-জাতীয় এত সংস্থা গড়ে উঠেছে তার ওপর একটি গবেষণা গ্রন্থ লিখে পাকিস্তানের বিদগ্ধ সেনা সমালোচক আয়েশা সিদ্দিকাকে মোশাররফ আমলে দেশ ছাড়া হতে হয়েছিল।
মিসরীয় মিলিটারিও একটি অথর্ব বাহিনী হিসেবে বিরাটাকারে গড়ে উঠলেও এর কোনো দন্তনখর নেই। বাহিনীর কেউকেটাদের নজর এর ব্যবসায়িক সম্পদের ওপর। মিসরীয় সেনাবাহিনীর কিছু একক বীরত্বগাথা থাকলেও যুদ্ধের ময়দানে এর অর্জন সামান্য ও ম্লান। প্রধান শত্রু (অতীতে) ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ করে মিসর একক বা সম্মিলিতভাবে কোনো যুদ্ধ জয় করতে পারেনি। মিসর 'ইয়ুস কাপুর' নামে শেষ যুদ্ধটি করেছিল ১৯৭৩ সালে এবং সুয়েজ খাল অতিক্রম করে খালের অপর পারে ১৯৬৭ সালেই মোতায়েন ইসরায়েলি বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলেছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত এ যুদ্ধে ইসরায়েলই জয়লাভ করেছিল।
ইয়ুস কাপুর যুদ্ধের পর মিসরীয় সেনাবাহিনী আর কখনো যুদ্ধ করেনি, যদিও মিসরীয় সেনাবাহিনীতে 'ফিল্ড মার্শাল'ও (যে পদবি যোদ্ধা হিসেবেই অর্জন করা যায়) আছে। ১৯৭৩ সালের পর মিসরীয় মিলিটারি কোনো আঙ্গিকে কোনো যুদ্ধ দেখেনি। এমনকি সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে 'ডিজার্ট স্টর্ম'ও নয়। অথচ শুধু নামেমাত্র সাদ্দামবিরোধী কোয়ালিশনে যোগ দিয়ে মুবারক ৩০ বিলিয়ন ডলার ঋণ মওকুফ করিয়ে নিয়েছিলেন মার্কিনিদের কাছ থেকে। ডিজার্ট স্টর্মে এমনকি বাংলাদেশ মিলিটারিরও একটি কনটিনজেন্ট ছিল।
বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত এবং প্রশংসিত বাহিনীগুলো তাদের ট্রেনিং তৎপরতা, সব ভূমিতে ও ঋতুতে সামরিক মহড়া এবং সশস্ত্র সীমান্ত সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে তাদের মান ও সুনাম দুই-ই বজায় রাখে। মিসরীয় বাহিনীর এমন কোনো মানও নেই, সুনামও নেই। সেখানেই সমস্যা। তাদের তো কিছু একটার মধ্যে ব্যস্ত থাকতে হবে। তাই তার রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাপ্রসূত_তা ব্যবসা হোক বা ঠিকাদারি বা কেনাকাটা, এ সবের ভেতর লাভবান হতে চায়। সব বাহিনীতে 'কল্যাণ' বলে একটি বিষয় আছে, যার যথাযথ বণ্টন না হলে শুধু মিলিটারিতেই নয়, সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। একসময় তার বিস্ফোরণও ঘটে। তখন হয়তো আরেক দল কুশীলব দৃশ্যপটে আসে।
এ পর্যন্ত তাহরিরে, মুবারকের বিদায়ে, বিস্ফোরক-উত্তর পরিবর্তনে যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে তো মিসরীয় জনগণ এখন তপ্ত কড়াইয়ে, যদিও বাকিটা দেখতে আরো সময় লাগবে।

লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.