যমুনার চরে জাহাজ আটকা পড়েছেঃ টাকার শ্রাদ্ধ না করে কোদাল চালান

যমুনার চরে সার ও জ্বালানি তেল বহনকারী ৩০টি জাহাজ আটকা পড়ায় বাঘাবাড়ী বন্দর অচল হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। দৈনিক আমার দেশের রিপোর্টে জানা গেছে, বাঘাবাড়ী যাওয়ার পথে বেড়া উপজেলার মোহনগঞ্জ, পেঁচাখোলা, নাকালিয়া ও কৈটোলার বিভিন্ন স্থানে জাহাজগুলো সাত থেকে ১০ দিন ধরে আটকে আছে।

এসব জাহাজে ৫৫ হাজার বস্তা রাসায়নিক সার ও ৪১ লাখ লিটার জ্বালানি তেল রয়েছে। এতে জাহাজ চলাচল বন্ধ হওয়ার আশঙ্কাই শুধু নয়, সার ও জ্বালানি সঙ্কটের আশঙ্কাও প্রবলভাবে দেখা দিয়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়া হলে একদিকে সারের অভাবে গোটা উত্তরাঞ্চলের চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে জ্বালানি তেলের সঙ্কটে বিঘ্নিত হবে যান চলাচল। পাম্প মেশিন চালানো যাবে না বলে জ্বালানি তেলের সঙ্কট চাষাবাদকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। উদ্বেগের কারণ হলো, এর মধ্যেই বাঘাবাড়ী তেল ডিপোর আপত্কালীন মজুদে হাত পড়েছে।
রিপোর্টে জাহাজ আটকা পড়ার কারণও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধান কারণ হিসেবে যথারীতি এসেছে অপরিকল্পিত ড্রেজিং প্রসঙ্গ। চলতি বছরও নগরবাড়ী থেকে বাঘাবাড়ী পর্যন্ত কয়েকটি পয়েন্টেই ড্রেজিং-এর নামে বালু ওঠানোর কাজ করেছে কর্তৃপক্ষ। পুরো কাজও আবার একটিমাত্র ড্রেজার দিয়ে করানো হয়েছে। তথ্যাভিজ্ঞরা সোজা বলেছেন, এভাবে অপরিকল্পিত ড্রেজিং-এর মাধ্যমে নদীর গভীরতা বাড়ানোর প্রশ্নই উঠতে পারে না। কারণ, ড্রেজার দিয়ে কেটে তুলে আনা বালু তীরে ফেলার পর দু’তিন দিনের মধ্যে আবার তা নদীতেই গিয়ে পড়ছে। মাঝখান দিয়ে অপচয় হচ্ছে বিপুল অর্থের। বিষয়টি যে কর্তৃপক্ষের জানা নেই তা নয়। কিন্তু সব জানা সত্ত্বেও এবার শুধু নয়, টাকা পানিতে ফেলার এই অপকম্ম তারা বছরের পর বছর ধরেই করে চলেছেন। ফলাফলও যেমন হওয়ার তেমনই হচ্ছে—দীর্ঘ নদী পথের যেখানে সেখানে বালু জমে ডুবোচরের সৃষ্টি হচ্ছে এবং সে সব ডুবোচরে জাহাজও আটকে যাচ্ছে। যমুনার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতিটি নদ-নদীর অবস্থাই এখন একই রকম। এককালের প্রমত্তা নদ-নদীগুলো শুকিয়ে গেছে, আবার কোথাও কোথাও সরু খালে পরিণত হয়েছে। সেগুলো আজকাল পায়ে হেঁটেই পার হওয়া যায়। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে কিশোর-বালকরা যে ভরা বর্ষায়ও ফুটবল খেলে সে খবরও তো অনেক পুরনোই।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ভারতের কাছে পানি আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য কোনো অনুরোধ জানানো হয়নি। তেমন আশা করাটাও অবশ্য অনুচিত। কারণ, পানিমন্ত্রী শুরুতেই জানিয়ে রেখেছেন, ভারত ফারাক্কা পয়েন্ট দিয়ে কিছুটা হলেও পানি যে দিচ্ছে এতেই আমাদের খুশি থাকা উচিত! টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলেও মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন যা বোঝানোর তা বুঝিয়ে রেখেছেন। কিন্তু সরকারকেও বুঝতে হবে, এটা শুধু কথার কথা নয়, নদ-নদীর পানির সঙ্গে আসলেও বাংলাদেশের জীবন-মরণের প্রশ্ন সরাসরি জড়িত। সুতরাং কারা ক্ষমতায় থাকতে পারবেন কি পারবেন না তার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার ভারতের পানি আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য। সরকারকে সে লক্ষ্যে এখনই তত্পর হতে হবে। না হলে নদ-নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। সেগুলোতে শয়ে শয়ে ডুবোচর মাথা তুলবেই, জাহাজের পর জাহাজও আটকে পড়তে থাকবে।
ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ জোরদার করার পাশাপাশি এই মুহূর্তের করণীয় নিয়েও সরকারকে দ্রুত তত্পর হতে হবে। না হলে শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে সামনের দিনগুলোতে আরও অনেক ভোগান্তি পোহাতে হবে। তাই বলে ড্রেজিং-এর নামে এত বিপুল টাকার শ্রাদ্ধ করা চলবে না। ড্রেজিং যেহেতু করতেই হবে সেহেতু তা করা দরকার এমন সুষ্ঠু পরিকল্পনার ভিত্তিতে যাতে নদীর বালু নদীতেই ফিরে না যায়। একটি মাত্র ড্রেজার দিয়ে লোকদেখানো কসরত করার পরিবর্তে সরকারের উচিত মানুষের শ্রমকে কাজে লাগানো। এর ফলে একদিকে কয়েক হাজার শ্রমিকের জন্য রোজগারের ব্যবস্থা করা যাবে, অন্যদিকে নদীর বুকও অনেক গভীর হয়ে উঠবে। তখন আর যেখানে সেখানে জাহাজ আটকা পড়বে না। টাকা তো পানিতে যাবেই না।

No comments

Powered by Blogger.