হাওরবাসীর অধিকার by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

সাগরের মতো বিশাল জলাধারের নাম হাওর। হাওর সাগরের অপভ্রংশ। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া_এই সাতটি প্রশাসনিক জেলার ৭,৮৪,০০০ হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে দেশের হাওরাঞ্চল গঠিত। সুনামগঞ্জ জেলায় হাওরের সংখ্যা সর্বোচ্চ_১৩৩টি।


এ ছাড়া সিলেটে ৪৩টি, হবিগঞ্জে ৩৮টি, মৌলভীবাজারে চারটি, কিশোরগঞ্জে ১২২টি, নেত্রকোনায় ৮০টি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনটি হাওর রয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার ৪৮টি উপজেলা নিয়ে বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলের আয়তন পুরো বাংলাদেশের প্রায় দশ ভাগের ছয় ভাগ, অর্থাৎ ২৪,০০০ বর্গকিলোমিটার। প্রায় দুই কোটি জন-অধ্যুষিত হাওর বৈশিষ্ট্যে অনন্য এক স্বতন্ত্র সত্তা। এমন বিচিত্র জীবন-জীবিকা বাংলাদেশের আর কোথাও দেখা যায় না। একসময়কার সামন্তরাজাদের অঞ্চলগুলো তথা গৌড়, লউড়, তরপ, বানিয়াচং, ইটা ও জগন্নাথপুরের হাওর এলাকায় সর্ববৃহৎ ও প্রধান পানিপ্রবাহের উৎস সুনামগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদী। কথিত আছে, গৌড়ের রাজা ক্ষেত্রপালের সুরমা ও রত্নাবতী নামে দুই স্ত্রী ছিলেন। ক্ষেত্রপাল আমাদের বরাক নদী থেকে খাল কেটে আদি সুরমা নদীর সৃষ্টি করেন এবং স্ত্রী সুরমার নাম অনুসারে নদীর নামকরণ করেন সুরমা।
১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইনে জমিদারি-প্রথা বিলুপ্তির পর থেকে এই হাওরগুলো গ্রুপ-জলমহাল হিসেবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত হয়। জলমহালগুলো থেকে সরকারিভাবে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে মেয়াদ হিসেবে সাধারণত তিন বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। ইজারার শর্তে প্রথম দুই বছর মৎস্য আহরণ করা যায় না, তৃতীয় বছর করা যায়। এ ধরনের পাইল ফিশারির উদ্দেশ্য হলো, মাছের বংশবৃদ্ধি নিশ্চিত করা এবং ছোট মাছ নিধনে নিরুৎসাহ করা। অধিকাংশ ইজারাদার এ শর্ত লঙ্ঘন করে ইজারাপ্রাপ্তির পর থেকে প্রতিবছর মৎস্য আহরণ শুরু করে। এতে মাছের প্রজননক্ষেত্রগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পূর্ণতাপ্রাপ্তির সুযোগ না থাকায় মাছের বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
ইজারাদাররা অত্যন্ত প্রভাবশালী। রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্বের অধিকারী হওয়ায় সরকারি নিয়মনীতি ও নির্ভরশীল সামাজিক অনুশাসনের ধরাছোঁয়ার বাইরে তারা অবস্থান করে। হাওরের বিশাল জলরাশি যখন বর্ষায় বিলগুলোকে প্লাবিত করে, তখন তারা নির্ধারিত সীমানার বাইরের এই বিশাল জলরাশিরও একচ্ছত্র মালিকে পরিণত হয়। পরিধির বিশালত্বের কারণে ইজারাদার নিজেকে জমিদার বা সামন্তপ্রভু, আর প্রশাসনকে তার কর্মচারী এবং সাধারণ জনগণকে প্রজা ভেবে থাকে। প্রতিবছরই ভাসান পানিতে মাছ ধরা নিয়ে বিবাদে সাধারণ মৎস্যজীবী বা জেলেদের খুন করে হাওরের পানিতে ভাসিয়ে দিতে দ্বিধা করে না তারা। রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে বছরের পর বছর হাওরগুলো নামমাত্র মূল্যে ইজারা নিয়ে এই বিশাল জলাভূমি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে জমিদারি-প্রথায়। স্থানীয় মানুষ এই ইজারাদারদের কাছে বন্দি। বর্ষায় হাওর ভয়ংকর রূপ ধারণ করায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশাসনিক কাজ সম্পাদন অধিকতর দুরূহ হয়ে পড়ে। অসহায় সাধারণ মানুষকে ইজারাদাররা তখন সহজেই কাবু করতে সক্ষম হয়। জনগণ ইজারাদার বা ওয়াটার লর্ড ও জলপ্রভুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে চায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হাওরাঞ্চলের প্রতিবেশেও তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। হাওরের প্রতিবেশও ঋতুভেদে পানির প্রাপ্যতার ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শক্তিশালী মৌসুমি বায়ুর প্রত্যক্ষ প্রভাবে পানির সরবরাহ বেড়ে যাবে। কিন্তু প্রাক-বর্ষায় বৃষ্টিপাত হওয়ার সময়কাল কিছুটা এগিয়ে এলে বোরো উৎপাদন সমূহ ক্ষতির মুখোমুখি হবে। ভৌগোলিক অবস্থানগত অসুবিধা, সুশাসনের অভাব, প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং নীতিমালা বাস্তবায়নে অপারদর্শিতার সম্মিলিত প্রভাবে আমাদের বিপন্নতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে দরিদ্র ও সামাজিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দুর্ভোগ সবচেয়ে বেশি।
বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত বাড়লে নদীতে পানিপ্রবাহ বাড়বে এবং সেই সঙ্গে বাড়বে মাঝারি থেকে বড় বন্যার পৌনঃপুনিকতা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন বড় প্লাবন ঘটতে দেখা যাবে এবং দুটি বড় বন্যার মধ্যবর্তী সময়কাল ক্রমে কমতে থাকবে। শীতকালীন ক্ষীণমাত্রার বৃষ্টি আরো কমে যাওয়া এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত বাষ্পীভবন বেড়ে যাওয়ায় খরাপ্রবণতা বাড়বে।
বাংলাদেশের মোট এলাকা ১,৪৮,০০০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ১,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার প্লাবনভূমি। সারা বছর এ অঞ্চলগুলোর একটা বিরাট অংশ যথা_নদীগুলোর খাঁড়ি এবং হাওর, বাঁওড় ও বিলগুলো পানিতে ডুবে থাকে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। বড় নদীগুলোর নির্দিষ্ট প্লাবনভূমি প্রায় ৪৪,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা বর্ষা ও শরৎকালে পানিতে তলিয়ে যায়। কয়েক বছর পর পরই সুনামগঞ্জকে কেন্দ্র করে হাওর এলাকায় অগ্রিম বন্যা হচ্ছে। এর ফলে ফসল ও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
ঐতিহাসিকভাবে হাওর, বাঁওড় ও বিল এলাকাগুলো প্রধানত মাছ উৎপাদন এবং দেশের বিশাল মৎস্য পেশাজীবী সম্প্রদায়ের জীবিকা অর্জনের প্রধান সহায়ক ছিল। কিন্তু দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা মেটানোর অজুহাত দেখিয়ে এগুলো অতি-নিষ্কাশন করে শুকিয়ে ফেলে ক্রমে চাষযোগ্য ভূমিতে পরিণত করা হচ্ছে। আমরা ঐতিহাসিক জলসম্পদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছি। পাখি ও উভচর প্রাণিসম্পদ বিপন্ন হয়েছে। হাওর, বাঁওড় ও বিলের পানি শীত ও গ্রীষ্মে নদীনালা সজীব রাখত। সারা বছর নদীতীরের জলমানুষকে যোগাযোগ, নিষ্কাশন, সেচ, স্নান ও গৃহস্থালিকাজের সুবিধা দিত। আমাদের জীবন্ত সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতে হাওর এলাকার অবদান অনন্য। প্রধান কয়েকটি সংগীত ও লোকসাহিত্য সৃষ্টিবলয়ের মধ্যে এই হাওর এলাকার স্থান অগ্রগণ্য। উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া এবং নিম্নবঙ্গের ভাটিয়ালির সঙ্গে গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করতে হয় হাওরাঞ্চলের সংগীতভাণ্ডারের কথা। হাছন রাজা থেকে শুরু করে উকিল মুনশী হয়েও বর্তমানের বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের সৃষ্টিক্ষেত্র তো এই হাওরাঞ্চলের মাটি, পানি ও নিসর্গ। ব্রিটিশ আমলে রাজনীতিকদের আশ্রয়স্থল ছিল এই হাওরগুলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই হাওরগুলো ছিল আমাদের মুক্তাঞ্চল এবং আমাদের লালনক্ষেত্র।
হাওর এলাকা স্বাভাবিক বন্যায় দুই থেকে চার মিটার পানিতে তলিয়ে যায়। হাওর এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিকাংশ বাঁধ আগাম স্বাভাবিক বন্যা ঠেকানোর জন্য নির্মিত, যা বর্ষাকালে ডুবে যায়। আগে এসব এলাকায় স্থানীয় বোরো চাষ হতো_যার বীজতলা থেকে ধান পাকা পর্যন্ত সময় লাগত ১২০ দিন এবং চৈত্র মাসের মাঝামাঝি তা উঠে যেত। সুনামগঞ্জ ও সিলেট এলাকার নিম্নাঞ্চলে সম্প্রতি হাইব্রিড উচ্চ ফলনশীল বোরো ধানের চাষ শুরু হয়েছে। এ ধানগুলোর বীজতলা থেকে ধান পাকা পর্যন্ত ১৪০ থেকে ১৫০ দিন লেগে যায়। তাই হাওর এলাকায় এসব ধানের ফসল তোলার সময় বৈশাখ মাসের শেষ পর্যন্ত এগিয়ে যায়। হাওর এলাকায় আগাম বন্যার আশঙ্কা ঠেকাতে পারলে বিপুল পরিমাণ বোরো ফসল তোলা সম্ভব।
দেশের হাওর এলাকায় আগাম বন্যা যেমন একটি সমস্যা, যোগাযোগব্যবস্থার অভাব আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। হাওর এলাকাগুলোতে সুষ্ঠু বন্যা-ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে সমন্বিতভাবে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হয়। হাওরের পরিবেশ, মৎস্যসম্পদ, জলজ পাখির জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখার জন্য হাওরগুলোকে অভয়াশ্রম এবং হাওর এলাকায় জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করার দাবি উঠেছে। এলাকার ফসলবিন্যাস পরিবর্তন করে ফসলগুলো যাতে চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে উঠে আসে_এমন পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ফসল উৎপাদনের সুপারিশও কেউ কেউ করছেন।
ড্রেজিং বা পলি অপসারণের নামে হাওরের অতি-নিষ্কাশন বন্ধ করতে হবে। মৎস্যসম্পদ, জলজ পাখির জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করার জন্য সারা দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে নূ্যনপক্ষে একটি জলাধার চিহ্নিত করে তাতে বর্ষব্যাপী সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। দাবি উঠেছে, প্রতিটি ইউনিয়নের নির্দিষ্ট জলাভূমি ছাড়া অন্যান্য জলাভূমিকে সারা বছর উন্মুক্ত করে মৎস্যজীবীদের হাতে জনগণের সম্পত্তি হিসেবে ফিরিয়ে দিতে হবে।
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদের এক অপূর্ব লীলাভূমি। প্রকৃতি তার সব কিছু আমাদের উজাড় করে দিয়েছে। পরিতাপের বিষয়, আমরা সেই অবদানকে কাজে লাগিয়ে সবার জন্য উন্নতি নিশ্চিত করতে পারিনি। হাওর বাংলাদেশের এক অফুরন্ত সম্পদের আধার। এখানকার মাটি অত্যন্ত উর্বর। বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত ধানের এক-পঞ্চমাংশ আসে হাওরাঞ্চল থেকে। এই ধান যারা ফলায়, তারা সারা বছর পেটপুরে খেতে পায় না। আবার অকাল পাহাড়ি ঢল ক্ষেতের ধান কেড়ে নিয়ে যায়। হাওরে রয়েছে মাছের বিশাল ভাণ্ডার। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা হলে হাওর থেকে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার মৎস্যসম্পদ আহরণ সম্ভব। এই দেশ আমরা সবাই মিলে অর্জন করেছি। তাই সবার স্বার্থ যাতে মোটামুটি সামঞ্জস্য রেখে রক্ষা করা যায়, সেদিকে সদা তৎপর হতে হবে। সমাজে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর না হলেও তা সহ্যের সীমার মধ্যে রাখার চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। হাওরের সম্পদের ওপর অবহেলিত ও বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক।

লেখক : সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.