লোহাগাড়া সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে অনিয়ম দুর্নীতি দালালের দৌরাত্ম্য by পুষ্পেন চৌধুরী

লোহাগাড়ার পদুয়া ইউনিয়নের আলমগীর চৌধুরী গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে পদুয়া মৌজায় আড়াই লাখ টাকায় পাঁচ শতক কৃষিজমি কিনেছেন। তাঁর জমি নিবন্ধন (রেজিস্ট্রি) করতে খরচ হয় ৩৭ হাজার টাকা। চিকিৎসক শুভাশীষ রায় তিন লাখ টাকায় ছয় শতক জায়গা কিনেছেন গত বছরের মার্চে। তাঁর নিবন্ধন খরচ হয় ৪০ হাজার টাকা।


লোহাগাড়া সদরের মহুরীপাড়ার মো. রফিক মৃত্যুশয্যায় জমি নিবন্ধনের জন্য বাড়িতে কমিশন করতে চাইলে সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয় থেকে ২০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। স্থানীয় শামশুল ইসলাম স্ত্রীকে চার শতক জমি হেবা দান করতে চাইলে সাড়ে চার হাজার টাকা উৎকোচ নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট লোকজন। প্রায় একই রকম অভিযোগ আধুনগরের হরিণা গ্রামের নুরুল আবছার ও মো. ইব্রাহিমের। সবার দাবি জমির দলিল নিবন্ধন করতে সরকারি নির্দেশনার বাইরে ১০-২০ হাজার টাকা বাড়তি নেওয়া হচ্ছে। নিয়মানুসারে প্রতি লাখ টাকায় তিন হাজার টাকার স্ট্যাম্প, ব্যাংকে পে-অর্ডার দুই হাজার এবং নিবন্ধন খরচ দুই হাজারসহ মোট সাত হাজার টাকা প্রয়োজন হলেও নেওয়া হচ্ছে ১১-১২ হাজার টাকা।
অভিযোগ উঠেছে, লোহাগাড়ার আধুনগর সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয় ঘিরে সংঘবদ্ধ ১৫-২০ সদস্যের দালালচক্র গড়ে উঠেছে। চক্রটি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে সরকারি নির্দেশনার বাইরে বাড়তি টাকা আদায় করছে দীর্ঘদিন।
জানা যায়, সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ের সহকারী নুরুল ইসলামের মাধ্যমে বাড়তি টাকা আদায় ও সন্ধ্যার পর পদবি অনুসারে বণ্টন করা হয়। প্রকাশ্যে সরকার নির্ধারিত ফিসের হারের তালিকা টাঙানোর কথা থাকলেও তা রয়েছে নুরুল ইসলামের বসার আসনের পেছনে।
জানা যায়, লোহাগাড়ায় ১৫-২০টি দলিল নিবন্ধন হয়। এসব দলিল নিবন্ধনে গড়ে প্রতিদিন বাড়তি লক্ষাধিক টাকা আদায় হচ্ছে। দলিল লেখকদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায় কমিশন ফি, বায়নানামা রেজিস্ট্রি, হেবা দলিল, ওসিয়তনামা, অংশনামা, দলিল রেজিস্ট্রি, সই মহুরী, জরিপ সংশোধন ইত্যাদি বিভিন্ন দলিল সম্পাদনে দালালচক্রের মাধ্যমে পাঁচ-সাত গুণ বাড়তি টাকা আদায় করা হচ্ছে। অনেকে অভিযোগ করেন, মূল্যবান জমি নিবন্ধনে বিভিন্ন কৌশলে লক্ষাধিক টাকা পর্যন্ত উৎকোচ আদায় করা হয়। দাবি অনুযায়ী টাকা না দিলে ক্রেতা-বিক্রেতাদের ওপর চলে নানা ধরনের হয়রানি। দলিল লেখক হাফেজ আহমদ জানান, সম্প্রতি তিনি ৭৪ লাখ টাকা দামের একটি জমির দলিল নিবন্ধন করতে গিয়ে লাখে এক হাজার করে ৭৪ হাজার টাকা বাড়তি দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট লোকজনকে। দলিল লেখক সমিতির সভাপতি মো. হারেছ কিছু বাড়তি টাকা আদায় করা হচ্ছে বলে স্বীকার করলেও এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি।
যোগাযোগ করলে সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ের সহকারী নুরুল ইসলাম কোনো রকম উৎকোচ নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। নিবন্ধন ফির তালিকা প্রকাশ্যে না টাঙানোর ব্যাপারে কোনো সদুত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, এখন থেকে তালিকাটি প্রকাশ্যে টাঙানো হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পরিমল সিংহ বলেন, ‘সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দালালদের উৎপাত ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের ওপর নানা হয়রানি চলছে। কিন্তু অফিসটি আমার বিভাগের অধীন না হওয়ায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।’ উপজেলা চেয়ারম্যান জিয়াউল হক বলেন, ‘আধুনগর সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ের অনিয়ম দুর্নীতি এখন ওপেনসিক্রেট।’ লোহাগাড়া উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্যসচিব মাহবুবর রহমান বলেন, ‘এটি সরকারি পর্যায়ের অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত কার্যালয়। যেখানে প্রতিনিয়ত মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন।’ এ ব্যাপারে সাব-রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে প্রায় ১৫ জন দালাল রয়েছে। তাদের উৎপাত বেড়েছে। তবে আমি কোনো অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করিনি। বরং তিনজন দালালকে চিহ্নিত করে তাদের কার্যালয়ে ঢোকা নিষিদ্ধ করেছি।’ তিনি বিভিন্ন অভিযোগ খতিয়ে দেখবেন বলে এ প্রতিনিধিকে জানান।

No comments

Powered by Blogger.