গহন গহীন-জিশিন, সুনামি ও হিবিকুশা! by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

কোনো দিন স্বপ্নের মতো সুন্দর দেশটি নিয়ে শোকগাথা লিখব, দূরবর্তী কল্পনায়ও ভাবিনি। প্রায় এক যুগ ধরে নিয়মিত জাপানে আসা-যাওয়ার কারণে নিজের অজান্তেই সূর্যোদয়ের দেশখ্যাত দেশটির প্রতি অন্য ধরনের মমত্ববোধ করতে শুরু করি। জাপানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের সূচনা জ্যেষ্ঠ আত্মজার উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য ফুকুওকা নগরীর কিউশু ইউনিভার্সিটিতে জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হওয়ার দিন থেকে।


প্রথম যেবার জাপান যাই, বিমানবন্দরের বাইরে এসে উঁচু কণ্ঠে মেয়েকে সম্ভাষণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার আঙুল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা নাতি রাইয়ানের বিরক্তিমিশ্রিত উচ্চারণ 'উরুসাই' শুনে থমকে যায় উৎসাহ। পরে মেয়ের ব্যাখ্যায় জানা হলো, উচ্চারিত জাপানি শব্দটির অর্থ হৈচৈ, হট্টগোল!
জাপানকে নিয়ে একটা ছোট্ট লেখার নাম দিয়েছিলাম 'নৈঃশব্দের দেশে'। চারদিকে সুনসান এমন নীরবতা অন্য কোনো দেশে দেখিনি।
বিস্ময়কর ধ্বংসস্তূপের ওপর ততধিক বিস্ময়কর উন্নতি করেছে কোন দেশ, এ প্রশ্নের উত্তরে যে জবাবটি নিশ্চিতভাবে পাওয়া যাবে, তা হলো জাপান।
হিরোশিমা-নাগাসাকির দুঃসহ স্মৃতি জাপানিরা আজও ভোলেনি। কোনো দিন ভুলবেও না। তবে দুঃসহ স্মৃতির ভাণ্ডারে এখন যুক্ত হলো নতুন এই ধ্বংসযজ্ঞ, যা মুহূর্তের মধ্যে লণ্ডভণ্ড করে দিল সাজানো-গোছানো ছবির মতো সুন্দর একটি দেশের বিস্তীর্ণ জনপদ। প্রথমে ভূমিকম্প, পরে সুনামি; তারও পরে আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বৈকল্য এবং রশ্মির বিকিরণ। আণবিক রশ্মির অভিশাপ থেকে বুঝি জাপানের মুক্তি নেই!
জিশিন, সুনামি আর হিবিকুশা এই ভয়ঙ্কর তিন শব্দের কথা ভুলতে চেয়েছিল জাপানিরা। কখনো মানুষের দানবীয় আর কখনো প্রকৃতির অমানবিক রুদ্ররূপে তছনছ হয়ে গেছে জাপান।
প্রথমে বোমা পড়ল হিরোশিমায়, তিন দিন পর নাগাসাকিতে। এর আগে অসংখ্য ছোট-বড় বোমায় বিধ্বস্ত হয়েছে রাজধানী টোকিও। প্রাচীন রাজধানী কিয়োটো আর অসংখ্য ছোট-বড় নগরী। মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তি জাপান সম্রাট হিরোহিতোকে কাবু করে এনেও কী কারণে যে পরবর্তী সময়ে এত সব আক্রমণ পরিচালনা করে, তা এক দুর্জ্ঞেয় রহস্য। যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডা মরু অঞ্চলে পরীক্ষিত আণবিক বোমা আসলে কতটা ধ্বংসাত্মক ও কার্যকর তা পরীক্ষা করে দেখার জন্যই নাকি হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আণবিক বোমাবর্ষণ!
হিরোশিমা-নাগাসাকির হাইপো সেন্টারের (বোমাবর্ষণের ঠিক স্থানটি) ফলকে লেখা আছে : ধারণা করা হয়েছিল ধ্বংসস্তূপের কয়েক মাইল চৌহদ্দির মধ্যে ৭০ বছর পর্যন্ত ঘাসও জন্মাবে না। সেই ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসের ৬ ও ৯ তারিখ ভুলে গিয়েছিল জাপানিরা।
জাপানিদের কর্মযজ্ঞের তারিফ না করে উপায় কী! ২০০২ সালেই বোমা বিধ্বস্ত দুই নগরীর সবুজ নিগর্স দেখে চোখ জুড়িয়ে গেছে। কী চমৎকার সবুজের সমারোহ! হিরোশিমা-নাগাসাকির দুঃসহ স্মৃতির ওপর কেন প্রকৃতি তার পেলব হাতের প্রলেপ দিয়ে মানুষের নীচতাকে ঢেকে দিয়েছে।
কিউশুর প্রধান শহর ফুকুওকার নাকামুরা গাকুয়েন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর বিখ্যাত জাপানি লেখিকা মারি কাইগোর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় বেশ কয়েক বছরের। হিরোশিমার আণবিক বোমার অগি্নশিখা ও তার সংরক্ষণকারী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ফেরতা যোদ্ধা তাৎসু ও ইয়ামামোতোকে নিয়ে এক মানবিক দলিলস্বরূপ বই 'দ্য কিপার অব দ্য ফ্লেম : দ্য স্টোরি অব দি অ্যাটম বোম ইন হিরোশিমা' লিখে বিখ্যাত হয়েছেন তিনি। তাঁর বইয়ের বাংলা অনুবাদ 'হিরোশিমার অগি্নশিখা' লেখিকার অনুমতিক্রমে বাংলায় অনুবাদ ও প্রকাশকে অকিঞ্চিৎকর লেখক-জীবনের বড় এক কৃতিত্ব বলে মানি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর পরই ই-মেইলে যোগাযোগ স্থাপন করা হলো মারি কাইগোর সঙ্গে। এক দিন পর জবাব এল।
দীর্ঘ জবাব, হার্দিক এবং অনেক খবরবাহী।
মারি কাইগো লিখলেন, দ্বীপ-জাতি জাপানিদের ওপর প্রকৃতির যে রুদ্ররূপ বয়ে গেল, তার পূর্ণ চিত্র সহসা পাওয়া যাবে না। ধীরে ধীরে জিশিনের (ভূমিকম্প) ধ্বংসের নানা দিক উন্মোচিত হলো। তিনি জানালেন, ছবির মতো সুন্দর যে গ্রাম হোশিনো, জাপানি ভাষায় যার অর্থ তার প্রান্তর সেই গ্রামের ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি হয়নি সেই গ্রামে স্থাপিত হিরোশিমার অগি্নশিখার বেদিটি। সেই গ্রামে যে টাউন হলে তিনি সমাবেশ করেছিলেন, সেটিও অক্ষত আছে। নরশিতা নামক ভদ্রলোক যিনি আমাদের গাড়ি চালিয়ে ফুকুওকা থেকে হোশিনো নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনিও ভালো আছেন। কখনো যাচ্ছেন কিউশুর দৈনিক নিশিনিপ্পন-এর সাংবাদিক বন্ধু। ভালো আছেন ইউমুরি শিম্বুন জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক বন্ধুও। এঁরা আমাদের এবং আমাদের বই নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন। ভালো আছেন ফুকুওকা শহরের মনিরুজ্জামান ও তাঁর পরিবার। দোহারের এই তরুণ বাঙালি ফুকুওকায় জনপ্রিয় এক বাংলা রেস্তোরাঁর মালিক। ভালো আছেন তাঁর পরিচিত বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা, যাঁরা কিউশুর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ভালো আছেন ফুকুওকার উপকণ্ঠে সাসাগ্ধরা শহরতলিতে ভগবান বুদ্ধের শায়িত পাথরের মূর্তি, যা কি না বিশ্বের অন্যতম সেরা ও বৃহৎ বুদ্ধমূর্তি।
টোকিও নগরীতে কন্যা তালিরা, তাঁর স্বামী শওকত ও দুই সন্তান ভালো আছে_ওই তথ্যও তিনি দিতে ভোলেননি। যদিও বলেছেন ইতিমধ্যে বহুবার কন্যার সঙ্গে যে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে, এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত!
সবশেষে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াব। পৃথিবীর মানুষের শুভ কামনা তাদের পাথেয়, যার অভাব ছিল হিরোশিমা-নাগাসাকির বোমাবর্ষণের পর।
জিশিনের মতো ভয়ঙ্কর আর সুনামির মতো প্রাণঘাতী শব্দের সঙ্গে জাপানিদের পরিচয় বহু বছরের_শত শত বছরের। ভূমিকম্প (জিশিন) তো জাপানকে হরহামেশা নাড়া দেয় মৃদুভাবে। সুনামি তো এখন বিশ্ব শব্দভাণ্ডারেরই অংশ।
এখন আরেক বড় আতঙ্কের নাম হিবিকুশা, যার কুৎসিত রূপ জাপানিরা ভুলতে বসেছিল।
হিরোশিমা-নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত আণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তার বিকিরণের ফলে জাপানে এক ধরনের বিকলাঙ্গ মানুষ ভয়ঙ্কর সমস্যা হিসেবে এতকাল কুরে কুরে ক্ষয় করেছে জাপানি সমাজকে। দুই লাখ ২৭ হাজার ৫৬৫ জন হিবিকুশার দুঃসহ বোমা বহন করেছে জাপানি সমাজ।
এখন ফুকুসিমার পারমাণবিক তাপকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয়তার নিঃসরণ নতুন হিবিকুশাদের জন্ম দেবে কি না জাপানিদের এটাই আজ বড় দুশ্চিন্তা।
জাপান উঠে দাঁড়াবে, এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও জাপানিরা শৃঙ্খলার মধ্যে সব কিছু করছে যেমন তারা করত স্বাভাবিক সময়ে।
রুটির দোকানে লাইনে দাঁড়িয়েছেন, রুটির পরিমাণ কম দেখে ক্ষুব্ধ নন।
এত সহনশীল আর শৃঙ্খলাবদ্ধ জাতি ঘুরে না দাঁড়িয়ে পারে!

লেখক : অনুবাদক
fyamanchow@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.