রমজানে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া-কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেন সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুটে থাকেন।


আর ব্যবসায়ীরা বলেছেন, আমদানির সময় শুল্ক কর্মকর্তাসহ অন্যান্য সংস্থার চাঁদাবাজি, রাস্তায় পুলিশের চাঁদাবাজি, ফেরিঘাটে চাঁদাবাজি ও ট্রাকভাড়া বেড়ে যায়। ফলে ব্যবসায়ীদেরও কিছু করার থাকে না।
আসন্ন রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ও বাজার মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব শেখ ওয়াহিদ-উজ জামান। বৈঠকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ব্যবসায়ীরা যাতে বাজারে পণ্যের সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াতে না পারেন, সেজন্য পর্যাপ্ত মোবাইল কোর্টসহ বাজারের ওপর নজরদারি বাড়াবে সরকারের সংস্থাগুলো। বিভিন্ন স্তরের চাঁদাবাজি রুখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কঠোর উদ্যোগ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রমজান মাসে যাতে কোনোমতেই পণ্যের সরবরাহ ও দাম অস্থিতিশীল না হয়, সেজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব।
বৈঠকের পর ঢাকার জেলা প্রশাসক মুহিবুল হক কালের কণ্ঠকে জানান, রমজানসহ সারা বছর যাতে সরবরাহ স্বাভাবিক রেখে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা যায়, সে জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত চালু করার বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। কোনো ব্যবসায়ী যাতে পণ্যের মজুদ করে বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারেন, সেজন্য বৈঠকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বাজার তদারকি ও বাজারে সরকারি সংস্থাগুলোর নজরদারি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর কোনো ব্যবসায়ী যাতে একচেটিয়া মুনাফার লোভে বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারেন, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সরকারি বিক্রয় সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সারওয়ার জাহান তালুকদার। তিনি কলের কণ্ঠকে জানান, বৈঠকে রমজান মাসের প্রস্তুতি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা হয়েছে। তাতে গত বছরের তুলনায় পণ্যমূল্য, আমদানি ও সরবরাহসহ বিভিন্ন বিষয়ের তুলনা করা হয়েছে। এতে কোনো কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে বলে মনে হয়েছে। অবশ্য এক বছরের মধ্যে জ্বালানি তেলের খরচ ৪১ থেকে বেড়ে ৭০ টাকা হয়েছে। ব্যাংকের সুদের হার বেড়েছে। টাকার বিপরীতে বেড়েছে ডলারের দামও।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা এফবিসিসিআইর পরিচালক ও ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমি বৈঠকে রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে পরিবহন ভাড়া হঠাৎ করেই বেড়ে যাওয়া, বিভিন্ন পর্যায়ে পুলিশের চাঁদাবাজি, দলীয় ক্যাডারদের চাঁদাবাজিকে দায়ী করে এসব দূর করতে বলেছি।' তিনি বলেন, 'রমজান মাসে অন্য পণ্যের সঙ্গে পেঁয়াজের চাহিদাও বেড়ে যায়। ওই সময় প্রতিদিন ভারত থেকে ২০০ ট্রাক পেঁয়াজ আসে। এসব ট্রাকে পদে পদে চাঁদাবাজি হয়। শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারাও ডিস্টার্ব করেন। আর ভারতও জানে যে, রমজানে বাংলাদেশে পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই দেশটিও ইচ্ছা করে রমজানের আগেই বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।'
হেলাল উদ্দিন বলেন, লবণের দাম অস্বাভাবিক বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয় দুই লাখ টন লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় লবণ আমদানি করলে তা দলীয় লোকদের দিয়েই আমদানি করাবে। এতে দলীয় লোকেরা সুবিধা পেলেও তাতে লবণের দাম কমবে না। তিনি বলেন, 'বর্ষার কারণে আগামী দুই মাস দেশে কোনো লবণ উৎপাদন হবে না। তাই এই দুই মাস লবণ আমদানি উন্মুক্ত রাখার দাবি করেছি আমি।'
একাধিক সূত্র মতে, বৈঠকে উপস্থিত থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁরা যেকোনো মূল্যে চাঁদাবাজি নির্মূল করবেন। এ লক্ষ্যে আগামী ১০ জুনের মধ্যেই বৈঠক করে চূড়ান্ত কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন তাঁরা।
অন্য একজন কর্মকর্তা জানান, বৈঠকে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) প্রতিনিধি রমজান মাসে ভোজ্য তেলের সংকট হতে পারে বলে আশঙ্কা করেন। তখন বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেন ওই আশঙ্কা নাকচ করে দিয়ে বলেন, তেল, চিনি, ছোলাসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ ও আমদানি পরিস্থিতি যথেষ্ট সন্তোষজনক।
বৈঠকে শিল্প মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পুলিশ, মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআই, গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইসহ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.