চলতি পথে-বিরিশিরির আদিবাসী জাদুঘরে by দীপংকর চন্দ

রাত এখন অনেক। ধারণাতীত এক বিরূপ সময়ে নিপতিত আমরা। একান্ত বাধ্য হয়েই হাঁটছি নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার জারিয়া বাজারের দিকে। সামনে খানাখন্দে ভরা সরুপথ। পথের চারপাশে বিস্তৃত অন্ধকার নিকষ শরীর নিয়ে দাঁড়ানো। হঠাৎ দূরে এক বিন্দু আলো জোনাকির মতো ফুটে উঠল অন্ধকারের পটভূমিতে।
ধীরে ধীরে সেই আলো বাড়তে লাগল আকার-আয়তনে। একসময় একটা যান্ত্রিক শব্দ তুলে জ্যান্ত প্রাণীর মতো আমাদের দিকে ছুটে এল আলোটি। অন্ধকারের শরীর বিদীর্ণ করা সেই আলোটি আর কিছুই নয়, একটা যন্ত্রযানের অংশ। নেত্রকোনা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভ্রমণকারীদের কাছে ভীষণ পরিচিত এ যন্ত্রযান। হ্যাঁ, ভাড়ায় চলাচল করা মোটরসাইকেল এটি।
মোটরসাইকেল আমাদের পছন্দের বাহন নয়। কেবল কোনো উপায় না থাকায় চালক মো. মিজানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে বাধ্য হলাম আমরা। অতঃপর চুক্তি মোতাবেক চেপে বসলাম যন্ত্রযানে। মিজান বাতাসের বেগে উড়িয়ে নিয়ে চললেন যন্ত্রযান। আমরা আমাদের বিরূপ সময় পেছনে ফেলে আধা ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছালাম এক জনশূন্য, ঘুমন্ত বাজারে। মোটরসাইকেল থেকে নামতে নামতে ঝাপ ফেলা একটা দোকানের সাইনবোর্ডের দিকে তাকালাম আমরা। একি! সাইনবোর্ডের নিচে স্থাননামের উল্লেখিত অংশে বাজারের নাম যে ‘উৎরাইল’ লেখা! কিন্তু আমাদের গন্তব্য তো উৎরাইল নয়! মিজান আমাদের উৎকণ্ঠিত ভঙ্গি দেখে হাসলেন একগাল। তারপর জানালেন, নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুর উপজেলার উৎরাইল বাজারেরই অন্য নাম ‘বিরিশিরি’।
সে যা-ই হোক, নিজেদের অজ্ঞতার লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করতে করতেই দ্রুত খুঁজে বের করলাম ওয়াইডব্লিউসিএর পান্থনিবাস। পরিপাটি সেই পান্থনিবাসের দ্বাররক্ষী চন্দ্রদার সহায়তায় সম্পন্ন হলো রাত্রিযাপনের ব্যবস্থাটুকু। ভালোয় ভালোয় রাত কাটিয়ে পরদিন পথে নামলাম আমরা। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বাজারের কাছে। গত রাতের জনশূন্য বাজার এখন লোকে পরিপূর্ণ। পণ্য বেচাকেনায় বাঙালিদের পাশাপাশি বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষের অংশগ্রহণ থাকলেও দোকানপাটের মালিকানার প্রায় শত ভাগই বাঙালিদের অধিকারে। অথচ অনেক অনেক দিন আগে এ অঞ্চলের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুর্গম গারো পাহাড় এবং পাহাড় পাদদেশের এ নদী সমতলে বাস করত শুধু আদিবাসীরাই। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পাহাড়ে শিকার করত, বৃক্ষ থেকে ফল আহরণের পাশাপাশি নদী সমতলের জঙ্গলাকীর্ণ জমি আবাদযোগ্য করে ফলাত ফসল। সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য প্রতিটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীরই ছিল নিজস্ব শাসনব্যবস্থা। কিন্তু কালের বিবর্তনে তাদের এ শাসনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে মূলধারার মানুষ। রাষ্ট্রক্ষমতা পক্ষে থাকার সুযোগে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার হরণ করে ধীরে ধীরে তারা বসে পড়ে এ অঞ্চলের অধিপতির আসনে। তীব্র অনিচ্ছে সত্ত্বেও প্রতিকূল এ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, বিরিশিরিতে আজও বসবাস করছে গারো, হাজং, হদিসহ বেশ কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ। আধুনিকতার অনিবার্য স্পর্শে তাদের জীবনযাত্রাও আর আগের মতো নেই। পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে আচার-আচরণের প্রতিটি ক্ষেত্রেই লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। সৌভাগ্যের কথা, পরিবর্তনের সেই ছোঁয়াকে স্বীকার করেই ১৯৭৭ সালের ১৬ আগস্ট স্থাপিত হয়েছে এ অঞ্চলের আদিবাসীদের ঐতিহ্যের নিদর্শন সংরক্ষণের একটি প্রতিষ্ঠান—বিরিশিরি উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি।
বিরিশিরি বাজার থেকে অল্প দূরত্বেই অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি। হাঁটতে হাঁটতে সেদিকেই অগ্রসর হই আমরা। স্বর্ণা গেস্ট-হাউস অতিক্রম করে বাঁ দিকে এগোই। দেয়ালঘেরা প্রতিষ্ঠানটির নীল গ্রিলের গেট চোখে পড়ে আমাদের। গেট অতিক্রম করলেই শান-বাঁধানো পরিচ্ছন্ন পথ। পথের দুপাশে নিচু দেয়ালের সমান্তরালে বেড়ে উঠেছে সারি সারি দেবদারু গাছ। পথের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে স্তূপাকারে রাখা রাশি রাশি ইট-বালি-সিমেন্ট। কী হচ্ছে সেখানে? ‘প্রতিষ্ঠানের নতুন মিলনায়তন ভবন এবং অতিথিশালা নির্মাণকাজ’, জানালেন একাডেমির পরিচালক যতীন্দ্র সাংমা। একাডেমির মূল ভবনটি ইংরেজি এল আকৃতির। দ্বিতল এ ভবনের সামনে ছোট্ট একটি সাজানো বাগান। নিচতলার বারান্দা অতিক্রম করলেই প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ব্যবহূত কক্ষসমূহের অবস্থান। দোতলায় গ্রন্থাগার এবং উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি জাদুঘর। একাডেমির গ্রন্থাগারিক উৎপল কুমার দাস গ্রন্থাগার ঘুরিয়ে দেখালেন আমাদের, তারপর ঘুরিয়ে দেখালেন জাদুঘর।
এক কক্ষবিশিষ্ট এ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে আদিবাসী নৃগোষ্ঠীর ব্যবহূত বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী সামগ্রীর কিয়দংশ। আছে গারোদের মান্দি রুয়ান বা কুলা, খক জেং বা ঘুড়ি, গারো মহিলাদের পরিধেয় বস্ত্র দলাজিন, দকবান্দা, গেনা; গারো পুরুষদের পোশাক কটি, আছে হাজং পুরুষদের পরিধেয় বস্ত্র পটা, হাজং মহিলাদের পোশাক পাতিন, কোমর বানাসহ নিত্যব্যবহার্য নানা দ্রব্যাদি। নিত্যব্যবহার্য এসব দ্রব্যের অধিকাংশই আজ হারিয়ে গেছে রাষ্ট্রযন্ত্রের অপরিণামদর্শী নীতি গ্রহণে। জাদুঘর দেখতে দেখতে বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া আদিবাসীদের কথা ভাবি আমরা। ভেবে লজ্জিত হই ভীষণ। তাদের জীবন থেকে হাসি-আনন্দ-গান কেড়ে নেওয়ার বেদনা অনুভব করি অন্তরের অন্তস্তলে।

No comments

Powered by Blogger.