এভারেস্টে বাংলাদেশি নারী-সত্যিই জয় করলাম! চূড়ায় নিশাতের প্রথম অনুভূতি by তৌহিদা শিরোপা

‘পা রাখলাম এভারেস্টের চূড়ায়। মনে হলো সত্যিই কি জয় করলাম এভারেস্ট! আনন্দে কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। আবহাওয়া খারাপ ছিল। চূড়ায় ওঠার (সামিট) পর কী কী করব, সেসবের পরিকল্পনা ছিল। ভেস্তে গেল সব। উড়ন্ত তুষারের কারণে চোখে সবকিছুই ঝাপসা দেখছিলাম।’


গতকাল মঙ্গলবার মাউন্ট এভারেস্টের বেসক্যাম্পে নামার পরপরই মুঠোফোনে এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেন বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী নারী নিশাত মজুমদার। সকালেই নিশাত মজুমদার ও এম এ মুহিতের নেমে আসার কথা ছিল। অভিযানের মূল শেরপা মিংমা গ্যালজের ভাই পেমবা দর্জি শেরপাকে বারবার ফোন দিয়ে একটি নম্বর পাওয়া গেল। দুপুর ১২টায় হঠাৎ অপর প্রান্তের ফোনে রিংটোন শোনা গেল। প্রথমে ধরলেন পর পর দুবার এভারেস্ট বিজয়ী এম এ মুহিত। জানালেন, তাঁরা বেসক্যাম্পে সুস্থ অবস্থায় ফিরেছেন।
মুহিত ফোনটা দিলেন নিশাত মজুমদারকে। তাঁর হাসি শোনা গেল। বললেন, ‘কী কাণ্ড! কাঠমান্ডু চলে এলে। তোমাকে তো আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে।’ নিজের কথা বাদ দিয়ে কোথায় উঠেছি, কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না—এসব তিনি জানতে চাইলেন।
নিশাতকে জানালাম, আপনার কথা জানার জন্য পুরো দেশ অপেক্ষা করছে। এখন শুধু আপনার এভারেস্টের গল্প জানতে চাই। নিশাত বললেন, ‘আসলে কেমন লাগছে বুঝতে পারছি না। দুই বছর ধরে চেষ্টা করছি। আর এভারেস্ট চূড়ায় উঠেছি—এ অনুভূতি অন্য রকম। সামিট করার পর সব মিলিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা ছিলাম এভারেস্টের চূড়ায়। বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকাসহ ছবি তুলেছি।’
দুর্গম বৈরী পরিবেশের এভারেস্টে বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দিতে হয়েছে নিশাত মজুমদারকে। বিপদেও পড়তে হয়েছে। ফোনেই বললেন, ‘ক্যাম্প-১ থেকে ক্যাম্প-২-এ যাওয়ার সময় প্রায় ছয় হাজার মিটার উচ্চতায় তুষারধসের মুখোমুখি হই। আমার কপাল আর নাকে বেশ চোট লাগে। রক্ত বেরোয়।’
২৭ এপ্রিল সকালে ক্যাম্প-২-এর পথে যাচ্ছিলেন তাঁরা। নিশাত মজুমদার ও এম এ মুহিতের সঙ্গে ছিলেন চার শেরপা। নিশাত বলতে থাকেন বিপৎসংকুল অবস্থার কথা—‘ক্যাম্প-২-এ যাওয়ার পথে পড়ে কুম্বু হিমবাহ। সেই হিমবাহের ফাটল প্রায় ২০টি মই দিয়ে পার হতে হয়। এ সময় পানির পিপাসা পায় আমাদের। পানি পানের আগেই আমাদের ডান দিকের নুৎসে পর্বত থেকে তুষারধস হয়। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। খানিক পরে দেখি আমি হিমবাহের ফাটলের প্রায় তিন ফুট গভীরে অলৌলিকভাবে বেঁচে গেছি। তবে এখন ভালো আছি। জিনিসপত্র গোছানো চলছে বেসক্যাম্পে।’
বাংলাদেশের এভারেস্ট বিজয়ী প্রথম নারীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার এভারেস্ট জয় করার অভিজ্ঞতা কেমন? জানতে চাইলে মুহিত বলেন, ‘আমার দেখা বাংলাদেশে সেরা নারী পর্বতারোহী নিশাত। অনেক বছর ধরে আমরা একসঙ্গে পর্বতারোহণ করছি। ওর সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, কখনো হাল ছেড়ে দেয় না।’
তুষারধসের সময়টার কথা বললেন মুহিত, ‘আমরা পানি পানের জন্য থেমেছি। হঠাৎ দেখি খণ্ড খণ্ড তুষারধস হচ্ছে। ভাবছি, নিশ্চয় আমাদের দিকে আসবে না। নিশাত ক্যামেরা বের করে ছবি তুলছে। আমিও বের করব, সেই মুহূর্তেই প্রচণ্ড বেগে ভয়াবহ তুষারধস শুরু হলো। নাক-মুখ বন্ধ করে বসে থাকলাম। তা না হলে নাক-মুখে বরফ ঢুকলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। নিঃশ্বাস বন্ধ করে কতক্ষণ থাকা যায়।’
এর একটু পরেই মুহিত দেখলেন সবাই আছে শুধু নিশাত নেই। বললেন, ‘চারপাশে দেখতে লাগলাম। এর মধ্যে হালকা একটা গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেলাম। ৩০ ফুট দূরে নিশাত পড়ে আছে। গিয়ে দেখি সে উঠে বসার চেষ্টা করছে। নাক কপাল ফেটে রক্তাক্ত অবস্থা। এর মধ্যে আমাদের দিকে তাকিয়েই প্রথমে জিজ্ঞাসা করল, “আপনারা ঠিক আছেন তো?” এই হলো নিশাত। তবে উত্তর দিক (তিব্বত অংশ) থেকে দক্ষিণ দিক (নেপাল অংশ) বেশি বিপৎসংকুল ও ভয়াবহ।’
হাল না ছাড়ার জন্যই তো নিশাত মজুমদার এভারেস্ট জয় করতে পেরেছেন। মা-বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে? নিশাত বলেন, ‘মা ফোন করেছিলেন। আমি ভালো আছি কি না জানতে চাইলেন। একটু গুছিয়ে পরে আবার কথা বলব। আসলে এভারেস্ট সামিট করার সময় সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে যায়। ঠিকমতো খাওয়া হয় না। আসার সময় পা যেন চলছিল না আর। সামিট করার পরও কত লোক যে মারা যায়!’ সহযোগী শেরপাদের ধন্যবাদ জানান নিশাত। বলেন, ‘তাঁরা খুব সাহায্য করেছেন। দেশের মানুষের দোয়াতেই হয়তো ভালোভাবে ফিরতে পেরেছি। তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।’
সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল বা পরশু নিশাত ও মুহিত নেমে আসা শুরু করবেন বেসক্যাম্প থেকে। ২৮ মে তাঁরা কাঠমান্ডু পৌঁছাতে পারেন বলে আশা করছেন।

No comments

Powered by Blogger.