গণমাধ্যম-সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সীমারেখা by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

হিন্দু-বৌদ্ধ ভ্রাতৃবর্গের ব্রত পালনের সংখ্যা অসংখ্য। দিবস পালনের রেওয়াজটা ইংরেজদের আমলে বেশ ঘটা করে শুরু হয়। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নানা দিনে নানা অধিকার দিবস পালন করছে। ৩ মে ‘বিশ্ব প্রেস দিবস’ পালিত হলো। ১৯৯১ সালের ৩ মে দিবসটিকে বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।


১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৩ মে বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
এর প্রয়োজন ছিল এবং এখনো আছে। সাংবাদিকতা আজ পৃথিবীতে এক ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। প্রতিবছর সারা দুনিয়ায় বহু সাংবাদিক কর্মক্ষেত্রে প্রাণ দিচ্ছেন। বিশ্বের প্রেস স্বাধীনতার সাম্প্রতিক অবস্থানে বাংলাদেশ এখন আধা স্বাধীন। স্বাধীন সাংবাদিকতার ঝুঁকি সরকার, মৌলবাদী সম্প্রদায়, মাস্তান বা অত্যন্ত প্রভাবশালী বিত্তবান গোষ্ঠীর কাছ থেকে।
যাঁরা পাবলিক ফিগার বা জননায়ক, তাঁদের সম্পর্কে জনস্বার্থে সাংবাদিকদের নানা তথ্য পরিবেশন করতে হয়, যেসব তথ্য সংগ্রহ করা সহজ নয়। এ কথা ভেবেই বিশ্বের নানা দেশের সর্বশেষ আদালত এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে জনসমক্ষে যাঁদের কাজকারবার, তাঁদের সম্পর্কে পরিবেশিত তথ্য অসত্য হলেও একজন সংবাদসেবীকে দায়িত্ব বহন করতে হবে না, যদি সেই অসত্য সংবাদ ইচ্ছাকৃত, বিদ্বেষপ্রসূত ও ঘোর অবিবেচনাপ্রসূত না হয়। এই লক্ষণরেখার মধ্যে সাংবাদিকতার আচরণ নিয়ে নানা প্রশ্ন এখনো দেখা দেয়। আমাদের দেশে সাংবাদিকতা পেশা ঝুঁকিপূর্ণ সত্য। সম্প্রতি ইচ্ছাকৃত, বিদ্বেষপীড়িত ও ঘোর অবিবেচনাপ্রসূত প্রতিবেদনের প্রাদুর্ভাবও ঘটেছে, যার ফলে অনেকের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
এখন প্রায়ই শোনা যায়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মানে সংবাদপত্রের মালিকের স্বাধীনতা। কথাটি যে অনেকখানি সত্য তা অনেক কর্মরত সাংবাদিক হাড়ে হাড়ে বোঝেন। মুক্ত বাণিজ্যের সঙ্গে মুক্ত সংবাদপত্রের ব্যবসায়গত দিক থেকে সাদৃশ্য থাকলেও সমাজে তাদের গুরুত্ব ও কর্তব্যের ব্যবহারে বেশ ফারাক রয়েছে।
অভিযোগকারী তার মামলা প্রমাণে এবং অভিযুক্ত তার আত্মপক্ষ সমর্থন বা সাফাইয়ে তদন্তে প্রদত্ত জবানবন্দি ব্যবহার করতে পারে। অভিযুক্তের জবানবন্দির হদিস তৃতীয় পক্ষের পাওয়ার কথা নয়। এখানে কোনো নাগরিক তথ্য অধিকারের দাবিতেও তা না পাওয়ারই কথা। সবচেয়ে বড় কথা, যে বক্তব্য আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ বলে বিবেচিত হবে, তা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেই আর অপরাধ বলে গণ্য হবে না—এই ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়।
আমরা জানি, সাধারণত সংবাদপত্রের ওপর বিপদ আসে সরকারের কাছ থেকে। সমাজে যখন শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়, তখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা শুধু সরকার নয়; দুর্বৃত্ত, ক্ষমতাবান ও বিত্তবানদের হাতেও বিনষ্ট হতে পারে। এবং নানা কারণে সে সময় যদি সাংবাদিকেরা অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকেন, তবে তাঁরা সমবেতভাবে সেই আঘাত প্রতিরোধ করতে হিমশিম খেতে পারেন। সাংবাদিকদের অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা বলতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের হাতে নির্যাতিত সাংবাদিক টিপু সুলতান বলেছিলেন, ‘আমি আহত হওয়ার পর সাংবাদিকদের দুই ইউনিয়নের এক হয়ে যৌথ বিবৃতি দিতে ২১ দিন সময় লেগেছিল।’ সাংবাদিকেরা অনেক সময় নিজেদেরকে জাতির বিবেক বলে অভিহিত করেন। সেই জাতির বিবেক যখন বিদ্বিষ্টভাবে বিভক্ত হয়, তখন নাগরিকদের জন্য তা এক নাভিশ্বাস অবস্থা ডেকে আনে। কারণ সীমিত হলেও অনেক সময় বিক্ষুব্ধ ব্যক্তি স্থানীয় প্রেসক্লাবে গিয়ে প্রতিকার প্রার্থনা করে এবং পেয়েও থাকে।
আমাদের দেশে শিক্ষিতের সংখ্যা যা, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ পত্রিকা পড়ে থাকে। ধরা যেতে পারে, জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশের মতো মানুষ পত্রিকা দেখে। এতদসত্ত্বেও সংবাদপত্রের প্রভাব অপরিসীম। নিরক্ষর দেশে ছাপার অক্ষরে লেখা প্রত্যাদেশসম বাণীর ইজ্জত পেয়ে থাকে। সন্দেহ নিরসনের জন্য লোকে বলে, ছাপার অক্ষরে লেখা আছে না!
সাংবাদিকেরা প্রশাসনের মন্ত্রী ও কর্মচারী এবং অপরাধী চক্রের হোতাদের বিরুদ্ধে বেশ শক্ত প্রতিবেদন পেশ করছেন। যেকোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করার আগে তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সাংবাদিকতা নীতিমালার গোড়ার কথা। কোনো একটি অসত্য সংবাদ পরিবেশনের ফলে পেশার সব সাংবাদিকদের সম্মান নষ্ট হতে পারে। এবং ভবিষ্যতে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।
সংবাদপত্রে বিনিয়োগ বিত্তবানদের জন্য আজ এক আকর্ষণীয় মৃগয়ার বস্তু। মৃগয়ার সন্ধানে শিকারির অনেক সময় খেয়াল থাকে না। আশু প্রাপ্তি, চমক সৃষ্টি কিংবা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য অবিবেচনাপ্রসূত কিছু ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করতে তাঁরা দ্বিধা করেন না।
কোনো সংবাদপত্রের মালিকের পক্ষেই শুধু তাঁর নিজ স্বার্থসিদ্ধি কিংবা তাঁর মুনাফার জন্য কাজ করা সম্ভব নয়, তিনি যত খুশি নিয়ন্ত্রণাদেশ বলবৎ করতে পারেন, স্বীয় স্বার্থে আত্মদমন বা সেলফ সেন্সর করতে পারেন এবং সাংবাদিকদের কলম বেঁধে দেওয়ারও প্রয়াস চালাতে পারেন, কিন্তু তারও একটি সীমারেখা থাকবে। যদি তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানকে জিইয়ে রাখতে চান, তাহলে সাংবাদিকতার একটি মান অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। সেই বাঞ্ছিত মান রক্ষা করা না হলে পাঠক সেই সংবাদপত্র নাও পড়তে পারে। এবং পাঠকের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনো সংবাদপত্র টিকতে পারে না। তাই এদিক দিয়ে সংবাদপত্রের মালিক পাঠকের কাছে দায়বদ্ধ।
আজ রাজনৈতিক মেরুপ্রবণতার প্রভাব সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যেভাবে বিরাজ করছে, তার ফলে যেসব প্রতিষ্ঠানের সমাজে ভারসাম্য রক্ষার কথা, সেখানেও টালমাটাল অবস্থা দেখা যাচ্ছে। যে ভূখণ্ডে বাংলাদেশ রাষ্ট্র আজ অবস্থিত, সেখানকার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মতোই সংবাদপত্র এমন এক ভূমিকা পালন করছে, যা আমাদের ফিরে দেখা দরকার।
নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও সংসদ যে অদক্ষতা, অপারঙ্গমতা, যে অদূরদর্শিতা ও অসাফল্যের পরিচয় দিয়েছে, তা সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। সমাজে সংবাদপত্র কোনো সুরক্ষিত দ্বীপে বাস করে না। সাংবাদিকেরা সমাজে অন্যান্য পেশাজীবীর মতোই তাঁদের যে দুর্বলতা, অনেক সময় তা একই ধরনের। তাঁদের বচনে, উক্তিতে, আচরণে এবং তাঁদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে যে ফারাক দেখা যায়, তাও বিশেষভাবে ব্যতিক্রমধর্মী নয়। সাংবাদিকেরা সংবাদপত্রের পাঠক ছাড়াও সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রকৃত তথ্য পরিবেশনের জন্য দায়বদ্ধ।
মামলা বা তদন্ত চলাকালে যে সাবধানতা ও বিচক্ষণতা অবলম্বন করা উচিত, আমাদের সংবাদপত্র তা করতে অনেক সময় সক্ষম হয় না। বিচারকালে বা তদন্তকালে যেসব তথ্য বেরিয়ে আসে, তা আদালতে চূড়ান্ত রায়ের আগেই আলোচিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছে। আর এ ধরনের অনুশীলন গোয়েন্দা বিভাগের সমর্থন বা প্রণোদনা ছাড়া হওয়া কঠিন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এ ব্যাপারে কোনো স্বচ্ছতা নেই, কোনো জবাবদিহিও নেই।
সাম্প্রতিক কালে জবানবন্দি ও স্বীকারোক্তি নিয়ে আপাতদৃষ্টিতে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রায়শ ছাপা হতে দেখা যায়। এর ফলে অভিযুক্তদের যে স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় তা-ই নয়, অভিযোগকারী অর্থাৎ রাষ্ট্রপক্ষের স্বার্থও বিঘ্নিত হয়। এবং সেই মামলার সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয় এমন নাগরিকও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যদি সেই অসত্য সংবাদ ইচ্ছাকৃত, বিদ্বেষপ্রসূত ও ঘোর অবিবেচনাপ্রসূত হয়। এই অবস্থাটি অত্যন্ত আশঙ্কামূলক। এর পরে যখন কোনো ধরনের অস্তিত্বহীন জবানবন্দি বা স্বীকারোক্তি নিয়ে বিশদ আলোচনার অবকাশ সৃষ্টি হয়, তখন তা আরও বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও জনস্বার্থ এমনই একটি প্রশস্ত ভাবনা, যার সীমারেখা নিরূপণ করার দায়িত্ব অনেকখানি নির্ভর করে যাঁরা এর সুরক্ষা দেন। জনস্বার্থে তাঁদের নিজের কি অবকাশ, গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তাও কিন্তু নিজেদেরই নির্ধারণ করতে হবে। আর সেটা করা সম্ভব হলে বাংলাদেশ সংবিধানে বর্ণিত সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা জনগণের কাছে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
১২ মে ২০১০
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা। সাবেক প্রধান বিচারপতি।

No comments

Powered by Blogger.