আমাদের রুশনারা by শামীম আজাদ

এখন আমাদের রুশনারাকে পেতে হলে বেষ্টনী নিংড়ে যেতে হয়। এখন তাঁকে এসএমএস করলে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আসে না। এখন তাঁকে চাইলেই দেখতে পারি না। কিন্তু এর জন্য কোনো নালিশ নেই। কারণ, এটাই তো চেয়েছিলাম—আমাদের স্বর্ণচাঁপা রঙা সুযোগ্য মেয়েটি বিলেতে এমপি হবে আর বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।


ভোটযুদ্ধে আমাদের এলাকায় গজিয়ে ওঠা ধর্মান্ধতার রাজনীতি থেকে আমাদের মুক্ত করবে। আমাদের এই শ্রেণী ও বর্ণবৈষম্যের কমিউনিটিতে ঐক্য নিয়ে আসবে।
এবারের সাধারণ নির্বাচনে ওর জয়ে তা-ই প্রমাণিত হয়েছে। আর জয়ের পরপরই ওর বেড়ে গেছে ব্যস্ততা।
কিন্তু এরই ফাঁকে ও সর্বপ্রথম ধন্যবাদ জ্ঞাপন অনুষ্ঠানে এল। তার জন্য আমি একটি সিল্কের আলোয়ান নিয়েগিয়েছিলাম, সেটা কাঁধে জড়িয়ে পিঠ থেকে ঘন কালো চুলের গোছা সরাতে সরাতে বলল, ‘আই লাভ দেশি ম্যাটেরিয়াল।’ সে কথা আমার জানা। পশ্চিমা পোশাকের ওপর সব সময়ই শাল বা লম্বা স্কার্ফ ফেলে রাখে। এর বেশির ভাগই বাংলাদেশের কাঁথাকাজ, সিল্ক, লিনেন না হলে শুধুই সুতি।
জিজ্ঞেস করি, কী দরকার এ প্রজন্মের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের বাংলাদেশের কথা জানার বা ধারণ করার?
অবশ্যই তা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সেই বীরদের জানা উচিত, যাঁরা স্বাধীনতা ও অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। জানা উচিত বাংলা নববর্ষ, বাংলা ভাষার ইতিহাস ইত্যাদি যা কিছু তাকে এ দেশে সম্মানের স্থান দেবে। কেননা এটাই আমাদের পরিচয়।
কীভাবে এই অর্জন সম্ভব করলে?
আমি করিনি, আমরা সবাই করেছি। ভুলে গেলে হবে না এ দেশে আমাদের পূর্বপুরুষের সবার সংগ্রামের কথা। দলীয়ভাবে আমার পূর্বসূরি পিটার শোর এমপির কথা (পরর্বতী সময়ে লর্ড)। ভুলে গেলে হবে না আমার আগের আমাদের দলের কাউন্সিল পর্যায়ে সুযোগ্য নেতৃত্বের কথা। এমনকি আমার আগের সাবেক এমপি উনাকিংয়ের কথা, যাঁর সঙ্গে কাজ করে আমি পার্লামেন্ট সম্পর্কে অনেক শিখেছি। সবচেয়ে বড় কথা, ইস্টঅ্যান্ডের মানুষের কথা।
কী সেটা?
তারা কখনোই বর্ণবাদিতার পক্ষে, ধর্মবাদিতার পক্ষে নয়। কত বিশাল ভোটের ব্যবধানে আমরা পরাজিত করেছি রেসপেক্টকে! ইস্টঅ্যান্ডের মানুষের রায় প্রমাণ করেছে, ‘মানবিক ঐক্যের’ প্রতি তাদের আস্থা।
নির্বাচনের দিন ঠিক দুপুরবেলায় আমরা একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। আর তখন অনভিজ্ঞ এই আমিও শাড়ি ও বুট পরে লেবার সমর্থক আছেন এমন সব বাড়িতে গিয়ে মিনতি করে যাঁরা তখনো ভোটকেন্দ্রে যাননি, তাঁদের যাওয়া নিশ্চিত করেছি। তখন স্বেচ্ছাসেবক ইসমাইল যে রুশনারার ভাই তাঁকে চিনতাম না। কিন্তু কেউ না বললেও চেহারার মিল দেখে তাঁর কলেজে পড়ুয়া বোন নাভিনকে শনাক্ত করেছিলাম।
রুশনারা দেশি খাবার ভালোবাসেন কিন্তু স্বল্পাহারি। ‘আর ও যে কি বইপোকা! বই পেলে ওর আর কিছু লাগে না। সেই ছোটবেলা থেকেই।’ আর সব কিছুই ভেবেচিন্তে করে। ভীষণ পরিবারমুখী। গত ক’দিন নাভিন লেবার অফিসের চারতলা ওঠানামা করে বাড়ি থেকে মায়ের পাঠানো কর্মীদের খাবার তদারক করেছে। যারা মাংস খায় না, তাদের নিরামিষ খাবারের ব্যবস্থা করেছে। আজ সে কেবলই হাসছে। ‘আমাদের মা-বাবার অনেক ভূমিকা আমাদের বড় করার পেছনে।’ কিন্তু আমাদের প্রতি ওর কড়া নির্দেশ যেন ছবি কোনো কাগজে না ওঠে। দুটো ব্যাপার সে আলাদাই রাখতে চায়। আমিও রুশনারার চরিত্রে এ প্রবল মাত্রাজ্ঞান লক্ষ করেছি। নিজ লক্ষ্যে স্থির থাকার জন্য এটা অনেক জরুরি।
সাত বছর বয়সে এ দেশে আসা রুশনারার পারিবারিক ইতিহাস আর পূর্ব লন্ডনের আর দশটা বাংলাদেশি পরিবার থেকে আলাদা নয়। বাবা দ্বিতীয় প্রজন্মের এ দেশের বাংলাদেশি অভিবাসী। উচ্চাকাঙ্ক্ষী আফতাব আলী সিলেটের বিশ্বনাথের ভূরকি গ্রামে জন্ম নেওয়া এই কন্যার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান পাওয়ার পরই বড় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। আজ সেই স্বপ্নপূরণ হয়েছে। বিলেতে উড়ছে রুশানারার বিজয়কেতন।

No comments

Powered by Blogger.