জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-যৌন হয়রানির অভিযোগের সুবিচার হবে তো?

পুনরায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন নারী শিক্ষক তাঁর এক পুরুষ সহকর্মীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন। এই নিপীড়নের প্রতিবাদেই ক্যাম্পাসের ভেতরে-বাইরে গড়ে উঠছে নতুনতর আন্দোলন। বারবার এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম জোরালো আন্দোলন হয় বলে আমাদের কত সময় কত কথাই না শুনতে হয়।


কিন্তু আমরা এতে গর্ববোধ করি দুই কারণে, প্রথমত, এখানে প্রতিবাদী চেতনা সদা জাগ্রত বলে; দ্বিতীয়ত, এখানে যৌন হয়রানিকে হালকা নামে না ডেকে যথাযথ নামে, প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। আমরা মনে করি, যৌন নিপীড়নকে ইভ টিজিংয়ের মতো লঘু নামে ডাকার অনুশীলন নিপীড়ক-পক্ষীয় উদ্দেশ্যকেই হাসিল করে। অথচ নিপীড়নের শিকার মাত্রই জানেন, এর ভয়াবহতা কতখানি। তাছাড়া নামের এই লঘুকরণ হাইকোর্টের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে দিকনির্দেশনারও স্পষ্ট অবমাননা। নিপীড়নের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়ানো জাহাঙ্গীরনগরের প্রতিবাদী চেতনা নিপীড়নকে হালকা করার এ রকম প্রয়াসের রাজনৈতিকতাকে চিহ্নিত করতে পারে।
এ লেখার শুরুতে অভিযোগকারী সহকর্মীকে শ্রদ্ধা জানানোটা অতীব জরুরি মনে করছি। তাঁর সাহস, ধৈর্য এবং আরও নিপীড়নের আশঙ্কা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন নিজের ‘আত্ম’কে জারি রাখার জন্য। এ রকম উপর্যুপরী হয়রানির শিকার হওয়া নারীকে—বিশেষ করে তা যদি হয় কর্মক্ষেত্রে, যে কঠিন সময় পার করতে হয়, সেটি সহজেই অনুমান করা যায়। তাঁর ব্যক্তিপর্যায়ের প্রতিরোধ যখন কাজ করল না, তখন তিনি উপাচার্যের দ্বারস্থ হয়েছেন; মৌখিকভাবে জানিয়ে প্রতিকার আশা করেছেন। উপাচার্য এর বিহিত করবেন বলে ঘুরিয়েছেন এক বছর। এরপর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। ১৫ দিন অপেক্ষার পর তিনি অন্য আরও ৩০ জন নারী সহকর্মীকে নিয়ে আবারও লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তারপর বিষয়টি পত্রিকার পাতায় জায়গা পেয়েছে। অনেক শিক্ষক তাঁর সহযাত্রী হয়েছেন। কিন্তু তার আগের দীর্ঘসময় তিনি একাই প্রতিরোধ করেছেন। সেই সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নারী শিক্ষকের সঙ্গে সহযোগিতার আশায় যোগাযোগ করেছেন। তেমনি একজনের কাছে এও শুনেছেন ‘তুমি শিক্ষক-তোমার কাজ আন্দোলন উসকে দেওয়া নয়’। হায়! এসব জেনে বুঝতে পারি, নারী মাত্রই নারীর পক্ষের নয়। পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শের যে দাপট তাতে একজন নারীও আচ্ছন্ন থাকতে পারেন। আর এখানেই স্পষ্ট হয়, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে থাকা পুরুষতান্ত্রিকতার শক্তি। বুঝতে পারি, নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আাামাদের আরও অনেক দূর যেতে বাকি। আদালতের নির্দেশনামা আমাদের দাবির ভিত্তিটাকে শুধু স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু নারীর মেধা-মনন বিকশিত হতে পারে, এমন কর্মক্ষেত্র প্রস্তুত করতে আমাদের আরও দীর্ঘ লড়াইয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে।্র
ফিরে আসি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের্রআন্দোলন প্রসঙ্গে। ’৯২-এর ছাত্রীর যৌন হয়রানির প্রথম অভিযোগ থেকে শুরু করে আজ ২০১০-এর শিক্ষকের অভিযোগ পর্যন্ত ১৮ বছরে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ক্রমাগত আন্দোলন করে আসছেন। অনেকগুলো অভিযোগ সরাসরি উত্থাপিত হয়েছে, আদালতের নির্দেশ আসার আগ পর্যন্ত তীব্র আন্দোলনের মুখে যার অনেকগুলোর কিছু মাত্রার বিচার হয়েছে। তবে উল্লেখ করার মতো ঘটনার বিচার তো দূরে থাক, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। গত বছরের নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষকের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে এমন নানান কিসিমের ফন্দি করে আপাত অর্থে দমন করা হয়েছে। সে প্রক্রিয়ায় ‘হার্ড এভিডেন্স পাওয়া যায় নাই’ এই অজুহাতে ওই শিক্ষককে অভিযোগ থেকে নিস্তার দেওয়া হয়েছে। পাঠক ভাবুন তো, যৌন হয়রানির সব সময় হার্ড এভিডেন্স থাকে? তাই প্রচলিত নিয়মেও তো হার্ড এভিডেন্স তদন্তের জন্য একমাত্র বিবেচ্য হতে পারে না। আদালতের নির্দেশনায় যে সমস্ত আচরণকে যৌন নিপীড়ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগেরই হার্ড এভিডেন্স রাখা সম্ভব নয়। এবং এ কারণেই এই অপরাধ প্রমাণে গুরুত্ব দেওয়া হয় পারিপার্শ্বিক প্রমাণ তথা সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সের প্রতি। অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রাসঙ্গিক অন্যান্য ইতিহাস এবং অভিযোগসক্রান্ত ঘটনাবলির বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এভাবেই অভিযোগের সত্যতা এবং গুরুত্ব স্পষ্ট করা সম্ভব।
পুরোনো অভিজ্ঞতার কারণেই আবারও শঙ্কা জাগে, এই সেলেও কি ওই শিক্ষকের অভিযোগ প্রমাণে হার্ড এভিডেন্স খোঁজ করা হবে? না পেলে এই অভিযোগও মাঠে মারা যাবে? আমাদের এই রকম সন্দিহান হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, যদিও অনেকে বলতে পারেন এই প্রশাসন তো আর আগের প্রশাসন না—কিন্তু আমরা এই আমল আর সেই আমলের প্রশাসনের মধ্যে এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পার্থক্য্র দেখতে পাই না। বরং অভিযুক্ত কোনো পক্ষের, সে শিক্ষক কিংবা ছাত্র যিনিই হোন না কেন, ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারার উদ্দেশে চালিত শিক্ষক গ্রুপগুলো তা মেপেই করণীয় ঠিক করে। তাদের কাছে ন্যায়-অন্যায়ের বিভেদ দিয়ে রাজনীতির চর্চা অচল। তাই আমাদের মনে প্রশ্ন আসে, প্রশাসনের দলীয় লোক হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তিটি বানানো কোনো অজুহাতে কি রেহাই পেয়ে যাবে? সম্প্রতি এই অভিযোগের ক্ষেত্রেও এমন আলামত দেখা যাচ্ছে। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দৈনিক পত্রিকায় অভিযোগকারীর নামসহ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে। অভিযোগকারীসহ তাঁর পাশে দাঁড়ানো শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কুত্সা রটনা করা হচ্ছে। তাছাড়া একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেখতে পাই স্বয়ং উপাচার্য অভিযোগকারীর নিজ হস্তাক্ষরে স্বাক্ষরিত অভিযোগনামার পেছনে ইন্ধনদাতার সন্ধান করতে থাকেন। এসব দেখেশুনে আমরা সুষ্ঠু তদন্ত ও সুবিচার পাওয়া নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছি।্র
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ লড়াইয়ের ফসল হিসেবে প্রস্তাবিত যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালার একটি খসড়া দাঁড় করানো হয়েছিল। বারবার কর্তৃপক্ষীয় আশ্বাসের পরও সেটি আলোর মুখ দেখেনি। পরবর্তীকালে হাইকোর্ট অধ্যাদেশের মাধ্যমে ওই নীতিমালা বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কার্যত প্রশাসন অত্যন্ত দায়সারাভাবে নামে মাত্র একটি অভিযোগ সেল গঠন করে দিয়ে দায়িত্ব সারতে চেয়েছে। হাইকোর্টের রায়ের পরও নীতিমালাটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নেয়নি। বরং সাম্প্রতিককালের ঘটনায় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী স্বর যখন দানা বেঁধে উঠছে, প্রশাসন তখন ক্যাম্পাসের ভেতরে দুষ্কৃতকারীদের নিরাপদে রেখে, বহিরাগতদের (আমাদের বিবেচনায় সাংবাদিক, সংহতি প্রকাশকারীদের) প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। আমরা দেখতে পাই নিপীড়নের বিচারে প্রশাসনের সদিচ্ছা বারবারই দলীয় বিবেচনার তলে হারিয়ে যায়। এ পর্যায়ে আমাদের উপলব্ধি হলো, যৌন নিপীড়নের বিচার ও প্রতিকার নিশ্চিত করার জন্য যৌন হয়রানি-বিরোধী চৈতন্য সমুন্নত রাখা খুবই জরুরি। সেই সঙ্গে জরুরি নিপীড়নের পক্ষে ক্রিয়াশীল যাবতীয় প্রচারণার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর ও বাইরে সমানভাবে সতর্ক থাকা।
লেখকেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.