দুদকের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন-ডেসটিনির টাকা পরিচালকদের ব্যক্তিগত হিসাবে লেনদেন by অনিকা ফারজানা

ডেসটিনির পরিচালকেরা প্রতিষ্ঠানের অর্থ নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে লেনদেন করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রায় ১০০ কোটি টাকা স্থানান্তরের তথ্য পেয়েছে। বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব থেকে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে এসব অর্থ স্থানান্তর করেছেন ডেসটিনির পরিচালকেরা। গ্রুপে


পরিচালকদের মধ্যে শুধু ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল আমীনের ব্যক্তিগত হিসাবে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক হিসাব থেকে সব মিলিয়ে অর্থাৎ ‘কিউমুলেটিভ’ হিসাব অনুযায়ী মোট ৪৬ কোটি ২৭ লাখ ৬৮ হাজার ৯৮০ টাকা স্থানান্তরের খোঁজ পেয়েছে দুদক। পরিচালকদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে আজ বুধবার চিঠি পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে দুদক সূত্র।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ডেসটিনির বিরুদ্ধে তদন্তকারী কর্মকর্তারা তাঁদের প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসন্ধানের সমন্বয়কারী স্কোয়াড্রন লিডার তাহিদুল ইসলামের কাছে জমা দিয়েছেন। কমিশনের উপপরিচালক মোজাহার আলী সরকার ও সহকারী পরিচালক মো. তৌফিক প্রাথমিক পর্যায়ে অনুসন্ধানের দায়িত্বে ছিলেন।
জানতে চাইলে তাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় এক মাস কাজ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন নথিপত্র ও বিভিন্ন সূত্রের তথ্যাদি পর্যালোচনা করে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংক হিসাব থেকে পরিচালকদের ব্যক্তিগত হিসাবে প্রায় ১০০ কোটির টাকা মতো অর্থ স্থানান্তরের খোঁজ মিলেছে, যা এ পর্যায়ে মানি লন্ডারিং বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি জানান, ডেসটিনির কাছ থেকে কোনো রকমের সাহায্য পাওয়া যায়নি। ‘তাদের দুই দফা কাগজপত্রের জন্য তাগাদা দেওয়া হলেও তারা চাহিদামতো কাগজপত্র সরবরাহ করেনি। টালবাহানা করে এড়িয়ে গেছে’—এ মন্তব্য করে তাহিদুল ইসলাম জানান, এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
জমা দেওয়া প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের এমএলএম (বহুস্তরের বিপণন) পদ্ধতিতে গ্রাহকদের কাছ থেকে ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬৬ ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে তিন হাজার ৫৯৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছে এবং বিভিন্নভাবে তিন হাজার ৫৮৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে।
ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনের নামে ১৩৩টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৯২১ কোটি তিন লাখ টাকা সংগ্রহ করে এবং বিভিন্নভাবে ৯০০ কোটি টাকা নিজেরাই তুলে নিয়েছে। ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো অপারেটিভ সোসাইটির নামে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে ৮৩টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে এক হাজার ৪৪৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা সংগ্রহ করে এবং বিভিন্ন উপায়ে এক হাজার ৪১৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকা তুলে নেয়। এভাবে সর্বমোট পাঁচ হাজার ৯৬১ কোটি ৮২ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছে। এর মধ্য থেকে প্রায় পাঁচ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছেন ডেসটিনি গ্রুপের পরিচালকেরা।
পরিচালকদের অল্প কয়েকটি ব্যাংক হিসাবের লেনদেন থেকে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড ও ট্রি প্ল্যান্টেশনের ব্যাংক হিসাব থেকে ডেসটিনি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট হারুন-অর-রশিদের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ব্যক্তিগত হিসাবে আট কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে।
রফিকুল আমীন ও ফারাহ দীবার ব্যক্তিগত হিসাবে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড থেকে দুই কোটি ৯৬ লাখ ৪৭ হাজার টাকা, পরিচালক গোফরানুল হকের হিসাবে দুই কোটি ৯৮ লাখ টাকা, সাইদুর রহমানের হিসাবে ট্রি প্ল্যান্টেশন থেকে চার কোটি ৮১ লাখ ৫২ হাজার টাকা সরানো হয়েছে। এ ছাড়া ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড থেকে মোসলেহউদ্দিন স্বপনের হিসাবে চার কোটি ৩৫ লাখ ৪৭ হাজার টাকা সরানো হয়।
দুদকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেপাল চন্দ্র বিশ্বাস ও মিতু রানী বিশ্বাসের হিসাবে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড থেকে পাঁচ কোটি ১৯ লাখ ছয় হাজার টাকা, সাইদুর রহমান ও স্ত্রী জাকিয়া রহমানের যৌথ হিসাবে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড থেকে ৮৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা এবং বেস্ট এভিয়েশনের হিসাবে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস থেকে ১৫ কোটি টাকা স্থানাস্তর করা হয়। এ ছাড়া, শেখ তৈয়ুবুর রহমানের হিসাবে পাঁচ কোটি ৪১ লাখ ৯৯ হাজার ২২৬ টাকা স্থানান্তরের তথ্য পেয়েছে দুদক।
অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাদের মতে, প্রতিষ্ঠানের হিসাবের টাকা ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর করা বেআইনি। এটি মানি লন্ডারিংয়ের পর্যায়ে পড়ে। এ ছাড়া অনুসন্ধানের বিভিন্ন স্তরে গ্রাহকদের সঙ্গে ডেসটিনি কর্তৃপক্ষের প্রতারণার প্রমাণ পেয়েছেন কর্মকর্তারা। যেমন: গ্রাহকদের হাতে কম দামের পণ্য তুলে দেওয়া, ট্রি প্ল্যান্টেশনের নামে প্রতারণা, এমনকি বেস্ট এভিয়েশনের জন্য উড়োজাহাজ না কিনে তার অর্থ নষ্ট করা ইত্যাদি।
ডেসটিনি গ্রুপের এমডি মো. রফিকুল আমীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুদকের কোনো প্রতিবেদন আমার হাতে আসেনি। তাই কিছু বলতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে, দুদক গণমাধ্যমকে বিভ্রান্ত করছে এবং সংস্থাটি যদি মানি লন্ডারিংয়ের কথা বলেই থাকে, ভুল বলেছে।’ তিনি বলেন, ‘দুদক দেখতে পারে যে টাকা অন্য কোথাও গেল কিনা, বা দেশের বাইরে পাচার হলো কিনা। তা তো নিশ্চয়ই হয়নি।’
শুধু এমডি ও চেয়ারম্যান নয়, তিনি নিজেকে কোম্পানির একজন ডায়মন্ড পরিবেশক বলে দাবি করেন। রফিকুল আমীন বলেন, পরিবেশক হিসেবেই তাঁর হিসাবে এত টাকা লেনদেন হয়েছে এবং কোম্পানির টাকা নিজের ব্যাংক হিসাবে তিনি স্থানান্তর করেননি।

No comments

Powered by Blogger.