কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়-নজরুলতীর্থে স্বাগত by আলতাফ শাহনেওয়াজ

ফারজানা কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে পড়েন। পাঠ্য হিসেবে তাকে পড়তে হয় কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী ও সাহিত্য। আবার চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী গার্ডেন এবং আব্দুল্লাহ্—নজরুল এদেরও পাঠ্য। এটি ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র।


শিক্ষার্থীরা সবাই তাদের নিজ নিজ বিভাগের পাঠ্যসূচির বাইরে আবশ্যিক কোর্স হিসেবে নজরুলের জীবনী ও সাহিত্য পড়ছেন এখানে। নির্দিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে আবশ্যিক ১০০ নম্বরের এই কোর্সটি তারা পড়েন যথেষ্ট আনন্দ নিয়েই। কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ইমরান সাদেকের কথায় ফুটে উঠেছে এরই প্রতিফলন—‘নজরুলের সাহিত্য ও জীবনী পড়ে আমরা যেমন তাঁর সম্বন্ধে জানতে পারছি, তেমনি আনন্দও লাগছে। অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে আমি নিশ্চয়ই কম্পিউটার বিষয়ের পাশাপাশি পাঠ্য হিসেবে নজরুলকে এভাবে পড়তে পারতাম না।’
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনার ভেতরেও খুঁজে পাওয়া যায় চুরুলিয়ার দুখু মিয়াকে। দুটি মাত্র হল—‘অগ্নিবীণা’ ও ‘দোলনচাঁপা’। মঞ্চের নাম ‘চুরুলিয়া’ মঞ্চ, ‘গাহি সাম্যের গান’ মঞ্চ—পুরো ক্যাম্পাসটিই যেন জাতীয় কবির নামকে নানাভাবে ধারণ করে আছে।
২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে বাংলা, ইংরেজি, সংগীত এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান—এই চারটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। বর্তমানে কলা, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, সামাজিক বিজ্ঞান এবং ব্যবসায় প্রশাসন—এই চার অনুষদের ১৪টি বিভাগে এখন প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী। অন্যান্য বিভাগের মধ্যে রয়েছে চারুকলা, নাট্যকলা, ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, অর্থনীতি, লোকপ্রশাসন ও সরকার, হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং এবং হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট। চালু হওয়ার অপেক্ষায় আছে নৃত্যকলা, ফোকলোর এবং ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগ। এই বিভাগগুলোকে ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অনুমোদন দিয়েছে।
অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে কমবেশি সেশন জটের কবলে নিমজ্জিত, সেখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সেশন জট নেই। প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগগুলোর মধ্যে বাংলা, ইংরেজি, সংগীত ও কম্পিউটার বিজ্ঞান অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১ম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের স্নাতক সম্মান পরীক্ষা এর মধ্যেই শেষ হয়েছে। এখনও কোনো বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণির পাঠদান শুরু হয়নি। চলতি বছরেই স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু হবে। এ প্রসঙ্গে কম্পিউটার বিজ্ঞান অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সভাপতি এ এইচ এম কামাল বলেন, ‘এ বছরের জুনেই আমাদের বিভাগে মাস্টার্স ভর্তি শুরু হবে।’
কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষকেরা নিত্য-নতুন স্বপ্নে বিভোর। সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থী প্রতীকের চোখে মিউজিশিয়ান হওয়ার স্বপ্ন। হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল ছুঁইয়ে তিনি বললেন, ‘আমাদের এখানে সমস্যা আছে। তবে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় আমাদের সকল বিভাগের শিক্ষার্থী-শিক্ষকের মধ্যে এক ধরনের পারিবারিক সম্পর্ক আছে, আন্তরিকতা আছে। শিক্ষকরাও পাঠদানের ব্যাপারে যথেষ্ট মনোযোগ—এটিই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বৈশিষ্ট্য।’ প্রতীকের মতো একই রকম কথা বললেন চারুকলা বিভাগের তরুণ শিক্ষক দ্রাবিড় সৈকত। তাঁর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, ঘড়ির কাটা তখন রাত ১০টার ঘরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে বটতলায় বসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে তাদেরকে পড়া বোঝাচ্ছিলেন তিনি। এর ফাঁকে বললেন, ‘এটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। রাজধানীর মতো সুবিধা এখানে পাওয়া যাবে না জানি। তবু আমাদের স্বপ্ন অনেক। এই যে আমার শিক্ষার্থীরা বিকাল ৫টার পর ক্লাস শেষেও ছবি আঁঁকতে আউটডোরে যায়, ফিরে আসে রাতে—ওদের এই অসীম উদ্দীপনা আমাদের স্বপ্ন জাগায়। আর আমাদের শিক্ষকদের একটা বড় অংশ তরুণ হওয়ায় আমরা সবাই নিজেদের সর্বোচ্চটা দিতে চাই। লক্ষ্য একটাই—নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলব।’

২.
মাথার উপরে দুপুরের তপ্ত রোদ। সেই রোদ মাথায় নিয়ে ঘাসের উপর বসে একমনে ছবি আঁঁকছেন দীপঙ্কর। অন্যদিকে সংগীত বিভাগের ক্লাসরুমে তখন চলছে রবীন্দ্র সংগীত—‘ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে...’—বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা স্থানে এভাবেই চলছে সংস্কৃতি চর্চা। সংগীত, চারুকলা ও নাট্যকলা বিভাগের মাধ্যমে এখানে যেন সংস্কৃতি চর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। বাংলা নববর্ষ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বসন্ত বরণ, পিঠা উৎসব, রবীন্দ্র জয়ন্তী প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন্দ্রিয়ভাবে উদ্যাপন করে বলে জানালেন শিক্ষার্থীরা। তবে নজরুল জন্মজয়ন্তীই এখানকার সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল মাওয়া বলেন, ‘সব অনুষ্ঠান ছাপিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তীতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ রঙিন হয়ে ওঠে। এসময় আমরা সকল বিভাগের শিক্ষার্থী মিলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিকে স্মরণ করি।’
এখানে প্রতি বছর তিন দিনব্যাপী নজরুল জয়ন্তী উৎসবে নজরুল সাহিত্য ও সংগীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দুজন প্রতিথযশা ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সম্মাননা দেয়া হয়। এবছরও নজরুলের ১১৩তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে নানা আয়োজনে মুখর হয়ে উঠবে ক্যাম্পাস। ‘নজরুলের জন্মদিনে এবার মধুমালা নাটকটি করব’—চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী শুভাশীষ জানালেন। পাশ থেকে আরেকজন বললেন, ‘সংগীত বিভাগের আয়োজনে পরিবেশিত হবে শতকণ্ঠে নজরুলের গান।’ নজরুলের জন্মজয়ন্ত্ত উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এখন তাই সাজ সাজ রব।

No comments

Powered by Blogger.