উপকূলের তেল-গ্যাস, আগুন নিয়ে খেলা? by মো. ফারুক হোসেন

আলাস্কার আর্কটিক ন্যাশনাল ওয়াইল্ডলাইফ রিফিউজ এলাকার মতোই যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল সাগরে তেলকূপ খনন বেশ কিছুদিন ধরেই এক বিতর্কিত ইস্যু। এর পক্ষ-বিপক্ষ উভয় দলে যুক্তির শেষ নেই। এরই প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গত ৩১ মার্চ উপকূলীয় অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন পরিকল্পনায় সমর্থন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।


দশকজুড়ে চরম বিতর্কিত এমন একটি বিষয়ে তাঁর এই ঘোষণার পর পরিবেশবিদেরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ওবামা আগুন নিয়ে খেলছেন। এসব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে মাসও পুরল না, এর আগেই ঘটে গেল ঘটনা।
২০ এপ্রিল মেক্সিকো উপসাগরে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম পরিচালিত ‘ডিপওয়াটার হরাইজন’ নামের তেলক্ষেত্রে বিস্ফোরণ হলো। মারা গেল ১১ শ্রমিক। বন্ধ হয়ে গেল ওই তেলক্ষেত্র থেকে তেল উত্তোলন। ১১ জনের মৃত্যুই যথেষ্ট ছিল কিন্তু ঘটনা সেখানেই থামল না। বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত রিগ ২২ এপ্রিল থেকে সাগরবক্ষে ডুবতে শুরু করে। সাগরপৃষ্ঠ থেকে বহু নিচে, এক মাইল গভীরে ফেটে যাওয়া পাইপ থেকে অনবরত বেরিয়ে পড়তে থাকে তেল। সাগরের পানি ঢেকে যেতে থাকল অশোধিত কালো তেলে। ঘটনা মোকাবিলায় শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। যাবতীয় চেষ্টা সত্ত্বেও তেলের নিঃসরণ বন্ধ করা যায়নি।
এ মুহূর্তে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার ব্যারেল (২১০,০০০ গ্যালন ) তেল সমুদ্রের পানিতে মিশছে। তেলের স্তর ছড়িয়ে পড়েছে মেক্সিকো উপসাগরের হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। কয়েকটি স্থানে উপকূল পর্যন্ত পৌঁছেছে এই তেল। হুমকির মুখে পড়েছে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা। এলাকাটি যুক্তরাষ্ট্রের চিংড়ি, মৎস্য ও সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের একটি বড় উৎস। একই সঙ্গে সামুদ্রিক পাখি, কচ্ছপ, ঝিনুক, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও উভচর অনেক প্রাণীর জন্য ওই সামুদ্রিক এলাকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, পানিতে তেল ছড়িয়ে পড়ার কারণে ছয় শতাধিক সামুদ্রিক প্রাণী হুমকির মুখে পড়বে।
ওই অঞ্চলের একটি পরিবেশ গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক লুঅ্যান হোয়াইট বলেন, ‘মেক্সিকো উপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে পাখি প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে এলাকাটি আমরা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি, তেলের কারণে তা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।’
তেল কোম্পানি বিপি বলেছে, তারা তেল পরিষ্কার করে ছাড়বে। তবে ঘটনার দায়দায়িত্ব যন্ত্রপাতি সরবরাহকারীসহ অন্যদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছে তারা। মার্কিন সিনেটে জবাবদিহির জন্য বিপি ও সংশ্লিষ্টরা একে অন্যকে দোষারোপ করার জন্য তৈরি হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত ঘটনা যেখানেই শেষ হোক এবং ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব কমবেশি যা-ই হোক; সমুদ্রে তেল-গ্যাস উত্তোলনের কাজটাই যে এখনো খুব বিপজ্জনক রয়ে গেছে, এই ঘটনা তাই আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল।
সাগরের লোনা পানিতে যন্ত্র বা সরঞ্জাম সহজে ক্ষয়ে যায়। সাগরবক্ষে আবহাওয়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেকোনো সময় তা ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে। মানুুষ সেখানে কার্যত অসহায়। ১৯৮৮ সালে উত্তর সাগরে কনডেনসেটে আগুন লেগে বিস্ফোরণে একটি খনির প্ল্যাটফর্মে ১৬৭ জন প্রাণ হারায়।
এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরাই স্বীকার করেন, বিভিন্ন কারিগরি বিপত্তি অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। কিন্তু কর্মীদের ওপর যে সার্বিক হুমকি ও প্রাকৃতিক পরিবেশের যে ঝুঁকি, তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
গত ২৬ এপ্রিল কয়েকজন মার্কিন সিনেটর একটি খোলা চিঠিতে লিখেছেন, সমুদ্র থেকে তেল-গ্যাস উত্তোলনের জন্য প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ যতই নিরাপদ বলে দাবি করা হোক না কেন, মেক্সিকো উপসাগরের ঘটনা মনে করিয়ে দিল, এটা কতটা উদ্বেগের বিষয়।’
তবে এ ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ভুগতে হবে সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ওবামাকে। সমুদ্র উপকূল থেকে তেল-গ্যাস উত্তোলনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিরোধীদের সমর্থন আদায়ের কাজটা তাঁর জন্য এখন আরও অনেক কঠিন হয়ে গেল।

No comments

Powered by Blogger.