চারদিক-সম্প্রীতির অন্বেষায় জাদুঘর by মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম

যাবতীয় স্মৃতিময় উপাদান সংগ্রহের আধার জাদুঘর। আধুনিক বিশ্বে বসবাসকারী সমগ্র মানবজাতির অতীতের ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাকীর্তি, ফোকলোরিক, নৃতাত্ত্বিক, জাতিতাত্ত্বিক, কৃষ্টি ও সামাজিক সংস্কৃতির শরীরকে ধরা যাবে জাদুঘরে। যা অতীত ও বর্তমানের যোগসূত্রের অমোঘ বন্ধন তথা গোটা জাতির তাবৎ সংস্কৃতির দর্পণ।


পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের সংগ্রহ, সংযোজন, গবেষণা, প্রকাশনা কর্মসম্পাদন এবং দৃশ্যত আপামর দর্শকের উদ্দেশ্যে পরিদর্শনের তথা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে রুচিবোধের নান্দনিকতা, সৌন্দর্যবোধ, আবেগ-অনুভূতি, মেধা-মনন, চিন্তা-চেতনা, অভীপ্সা-কল্পনা ইত্যাদি নিয়ে জাদুঘরের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। জাদুঘরের সঙ্গে মানব সংস্কৃতি এবং আপন আপন সংস্কৃতির সঙ্গে মানবজাতির সেতুবন্ধন রচিত হয়।
নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী ছাড়াও শাসক, নৃপতি, জমিদার, সামন্তপ্রভু, জাতি, উপজাতি, আদিবাসী, স্বীয় ধর্মীয় ও অপরাপর ধর্মের নৃতাত্ত্বিক দেহ কাঠামোর ভিন্ন ভিন্ন জাতির সবারই স্মৃতিময় নিদর্শন নিয়ে জাদুঘরের গ্যালারিগুলো সাজানো হয়ে থাকে, তবে কখনো ব্যত্যয় ঘটিয়ে কিছু কিছু বিষয়ে বিশেষায়িত জাদুঘর সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ডাক জাদুঘর, মুদ্রা জাদুঘর, নৌকা জাদুঘর, এনাটমি জাদুঘর ইত্যাদি।
পৃথিবীর তাবৎ ভূখণ্ডে বসবাসকারী সব জনপদ, জনগোষ্ঠী, জাতি, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদির নিদর্শন নিয়ে সংগ্রহশালা, যেখানে কাউকে উচ্চপর্যায়ের, মধ্যমস্তরের অথবা নিম্নপর্যায়ের ভাবা হয় না। সবাইকে সমগুরুত্ব দেওয়া হয়, উদ্দেশ্যই হলো অশ্বত্থ বৃক্ষের ছায়ার অনুরূপ সর্বজনীন লক্ষ্যে একই পতাকার অনুসারী হয়ে শোভাযাত্রায় অংশ গ্রহণ করা। এ উদ্দেশেই আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদ (ICOM)) যথার্থই এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘সম্প্রীতির অন্বেয়ায় জাদুঘর’।
আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিষদের প্রতিপাদ্য অনুসারে জাদুঘর পরিমণ্ডলে আমরা এখনো পশ্চাৎপৃষ্ঠে ধীরগতিতে চলমান। এ গতি থেকে উৎরানোর জন্য উপযুক্ত উদ্যোগ-প্রচেষ্টা এবং নানাবিধ কারণে কর্ম-উৎসাহের অভাব, পুরাকীর্তির গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে উদাসীনতা জাদুঘরবিষয়ক উপযুক্ত নীতিমালার অভাব হাল আমলে প্রাচীন পুরাকীর্তির আইন সাধারণ মানুষের জাদুঘর সম্পর্কে সীমিত জ্ঞান, সংশ্লিষ্ট গবেষকদের গবেষণাকর্মে উন্নাসিকতা ইত্যাদি কারণে আমরা আধুনিক বিশ্বের জনপদের কথিত প্রথম শ্রেণীতে অবস্থান করলেও অন্যান্য দেশের তুল্যমানে উন্নয়নের ধারায় ঊষার আলো দেখা যায় না। যা প্রমাণ করে আমরা বাক্যে পটু, কাব্যে সিদ্ধহস্ত, কর্মে বিপরীত মেরুর।
জাদুঘর ও জনপদের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনার জন্য, তাদের মধ্যে সৌন্দর্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন পারস্পরিক জানাশোনা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার জন্য আরও বেশি বেশি স্মৃতিময় নিদর্শন জাদুঘরে সংগ্রহ করতে হবে। আজকে যা ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী, আগামীতে তা বিজ্ঞানের উন্নয়নের ফলে হারিয়ে যাবে। সে জন্য এখনই সেসব সংগ্রহ করে জাদুঘরে সংগ্রহ করতে হবে। তাতে অধিকতর ফললাভ করা যেতে পারে।
পুরাকীর্তি আমাদের জাতির মূল্যবান সম্পদ, এসব নানা সময় পাচারকারী চোর-তস্করদের হস্তগত হয়ে বিদেশিদের কাছে চড়ামূল্যে বিক্রি হয়ে যায়। বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে এ ধরনের পুরাকীর্তি চোরদের ধরা হলে নির্দিষ্ট অথবা কোন ধারায় শাস্তি প্রদান করা যাবে, এমন সেকশন বা ধারা ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোডে উল্লেখ করা নেই। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখতে পারে।
দেশের সব জাদুঘরে কম-বেশি সব জনগোষ্ঠীর নিদর্শন সংগৃহীত থাকে, কিন্তু প্রতিনিধিত্বমূলক নিদর্শন গ্যালারিতে দেখা যায় না। দেখা যায় যা উদ্বোধনের সময় উপস্থাপন করা হয়েছিল, সেভাবেই। এ জন্য জাদুঘরকর্মীদের দিবাস্বপ্ন থেকে জেগে আমাদের সংশ্লিষ্ট জাদুঘরকর্মীদের গবেষণা ও প্রকাশনায় এগিয়ে আসতে হবে। এখন বসে থাকার সময় নেই, অন্যথায় আন্তর্জাতিক জাদুঘর পরিমণ্ডল থেকে পিছিয়ে যাব। বিষয়টি আরও দর্শনীয় করার জন্য জাদুঘরের সামনের দিকে বড় আকারের নিদর্শন সাজানোর জন্য প্যাডেস্টাল, বেদি তৈরি করে সেখানে নিদর্শন উপস্থাপনার মধ্যে জাদুঘরের আবহ-পরিবেশ সৃষ্টি করে উন্মুক্ত জাদুঘর বা ওপেন এয়ার করা যায়।
আমাদের জাদুঘর বিভিন্ন সময় নানা রকম নিদর্শন সংগ্রহ করে থাকে বটে কিন্তু প্রাপ্ত নবতর নিদর্শন নিয়ে গবেষণা করা হয় না, পত্র-পত্রিকায় লেখা হয় না, লিখলেও পাঠকদের কাছে তত গুরুত্ব পায় না। এমন বাস্তব অবস্থার কারণে সর্বস্তরের মানুষ সে সম্পর্কে জানতে পারে না, কারণে-অকারণে নতুন নিদর্শনগুলো ওই জাদুঘরের মজুদঘরে পড়ে থাকে বছরের পর বছর। তাতে আগ্রহী দর্শক তা দেখা থেকে বঞ্চিত হয়। গবেষকেরাও তার কাছে যেতে পারেন না।
আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় যাই হোক না কেন, আমাদের এই পললভূমিতে প্রাপ্ত নিদর্শনাদির ঐতিহাসিক গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মূল্য সম্পর্কে আরও সচেতন হতে হবে। এ দেশ থেকে পুরাকীর্তি পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান প্রণয়ন করতে হবে। প্রতিটি জাদুঘরেই গ্যালারির নিদর্শন দর্শকদের আকৃষ্ট করার জন্য মাঝেমধ্যে অদল-বদল করতে হবে। গবেষণা ও প্রকাশনার গতি বৃদ্ধি করার জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। আধুনিক দ্রব্যসামগ্রী ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রহ করে সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করতে হবে। আর এ জন্য বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও বর্ণ-গোত্রের স্মৃতিময় নিদর্শনকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। আমরা যদি অতীতকে ভিত্তি হিসেবে অনুধাবন করে নিজেকে সংশ্লিষ্ট করতে পারি, তবেই সবার মধ্যে সম্প্রীতির সন্ধান পেতে পারি।

No comments

Powered by Blogger.