স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ-কাঠামোর ক্ষমতা খর্ব করা কার স্বার্থে?-বিটিআরসি বনাম মন্ত্রণালয়

প্রস্তাবিত ‘বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধিত) আইন-২০১০’ মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়ায় টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রণ কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। আইনটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সব ধরনের ক্ষমতা চলে যাবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সরাসরি এখতিয়ারে।


নতুন আইনের সংশোধনী প্রস্তাবে টেলিযোগাযোগ লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি, নীতিমালা প্রণয়ন, ফি ও ট্যারিফ-কাঠামো বিটিআরসির পরিবর্তে সরকার বা মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করবে। নিয়ন্ত্রণের এই নতুন ধরন টেলিযোগাযোগ খাতের বিকাশ প্রশ্নে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রণের স্বাধীন কাঠামো হিসেবে ১৯৯৮ সালে জাতীয় টেলিযোগাযোগ নীতিমালার আওতায় আইন ও কমিশন গঠন করা হয়। নতুন আইনের ফলে বিটিআরসির এই স্বাধীন ক্ষমতা থাকবে না। এ উদ্দেশ্যে টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১-এর ১৫ ধারায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনও আনা হয়েছে। বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর ধারণা, বিটিআরসি ১৫ বছরের অভিজ্ঞতায় দক্ষ এবং টেলিযোগাযোগ খাতের বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত। হঠাৎ এই দায়িত্ব সরাসরি মন্ত্রণালয়ের হাতে গেলে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। পাশাপাশি তারা সরকারি মালিকানায় মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি থাকায়, সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ থাকবে না বলেও অভিযোগ করেছে।
অন্যদিকে নতুন আইনে টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো অপরাধের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে নেটওয়ার্ক বন্ধ না করে প্রশাসক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। সাধারণভাবে এটি ইতিবাচক প্রস্তাব। তবে প্রশাসক থাকাকালে ক্ষয়ক্ষতির দায়দায়িত্ব সরকার না নেওয়ায় বিনিয়োগকারীদের জন্য তা সুরক্ষা হিসেবে কাজ করবে বলে মনে হয় না। এ খাতের অনিয়ম ও অপরাধের জন্য ৩০০ কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের জরিমানার বিধান শৃঙ্খলার স্বার্থে নিশ্চয় প্রয়োজনীয়; কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠান অভিযুক্ত হলে যাতে আপিল বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করা উচিত, প্রস্তাবিত নতুন সংশোধনীতে এ ধরনের কোনো বিধান নেই।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, বিটিআরসি যেখানে কার্যকর ভূমিকা রাখছিল, সেখানে মন্ত্রণালয়ের সরাসরি কর্তৃত্ব গ্রহণের প্রয়োজন হলো কেন? জ্বালানি খাতে অনেক অনিয়মের পরও স্বাধীন রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারলে শক্তিশালী বিটিআরসি থাকতে অসুবিধা কোথায়? ক্ষমতার এ রকম কেন্দ্রীভবন একদিকে দুর্নীতি অন্যদিকে দীর্ঘসূত্রতার কারণ হয়। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের স্বীকৃত পন্থা হচ্ছে, মন্ত্রণালয়ের নীতিগত দিকনির্দেশনার আলোকে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কার্যক্রম ও তদারকি পরিচালনা করা। সেই কাজের জন্য বিটিআরসিই উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রণালয়ের বরং প্রয়োজন সরকারি টেলিসেবা খাতের বিকাশে আরও নিষ্ঠাবান হওয়া। অন্যদিকে বিটিআরসির মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি সব টেলিসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যেন সরকারের রাজস্ব বাড়ানো, গ্রাহকের সন্তুষ্টি এবং প্রাযুক্তিক বিকাশে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি যাতে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে না জড়ায় তার নিশ্চয়তা সৃষ্টি করা। সরাসরি হস্তক্ষেপ এ কাজের অন্তরায়। তবে এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, বিটিআরসির ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে অভিযোগ রয়েছে; প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমে আরও স্বচ্ছতা প্রয়োজন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এর প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই।
এ রকম অবস্থায় আশা করা যায়, সরকার পুরো বিষয়টি নতুন করে ভাববে এবং টেলিযোগাযোগ খাতে জড়িত সবার সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। মন্ত্রণালয়ের এ ক্ষেত্রে নিজেই একটি পক্ষ হয়ে কাজ করা উচিত নয়। সুতরাং সামগ্রিকভাবে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করে বিটিআরসিকে অকেজো করা থেকে বিরত থাকাই সরকারের কাছ থেকে বাঞ্ছনীয়।

No comments

Powered by Blogger.