স্মরণ-সংগীতই ছিল যাঁর একমাত্র আরাধ্য by রাশেদুর রহমান

বাঙালি মুসলমান সমাজে সংগীতকে জনপ্রিয় করতে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, আবদুল আহাদ তাঁদের অন্যতম। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলা সংগীতের বহুমাত্রিক ধারায় তিনি নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন। একাধারে ছিলেন সুরকার, প্রশিক্ষক, পরিচালক, সংগঠক ও গায়ক।


বাংলায় মুসলমানদের মধ্যে সংগীতের যে বিস্ময়কর বিকাশ, তার সঙ্গে অনিবার্যভাবেই চলে আসে আব্বাস উদ্দীন আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম ও আবদুল আহাদের নাম। ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পর সংগীতশিল্পীদের একটি বড় অংশ এ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ফলে তখনকার পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) রাজধানী ঢাকা ও তার বেতার কেন্দ্র প্রায় সংগীতশিল্পীশূন্য হয়ে পড়েছিল। তাই জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজন হয়ে পড়ে ঢাকা বেতার কেন্দ্রকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর।
এই গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন আবদুল আহাদ। সেই সময় পূর্ববাংলার পরিবেশ সংস্কৃতি, বিশেষত, সংগীতের বিকাশের জন্য মোটেও অনুকূল ছিল না। কূপমণ্ডূকতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, পরমতসহিষ্ণুতার অভাব, অপসংস্কৃতির দৌরাত্ম্য, সংকীর্ণ মানসিকতা—সবকিছু মিলিয়ে এক অসহনীয় পরিবেশ। এর মধ্যেই ঢাকাকে ঘিরে আবদুল আহাদ এক বিস্ময়কর যুগের প্রবর্তনে সক্ষম হয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা সহায়ক হয়েছিল।
আবদুল আহাদ ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায় শান্তিনিকেতনে তিনি শিক্ষা নিয়েছিলেন। শান্তিদেব ঘোষ ও শৈলজারঞ্জন মজুমদার ছিলেন তাঁর শিক্ষক। ১৯৩৮ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে যান। এর আগেই অবশ্য তাঁর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৩৬ সালে কলকাতায় অল বেঙ্গল মিউজিক প্রতিযোগিতায় ঠুংরি ও গজলে প্রথম স্থান অধিকার করে আবদুল আহাদ তখনকার সংগীতজগতে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।
শান্তিনিকেতনের শিক্ষাজীবনে আবদুল আহাদ সাহিত্যসভা, গানের অনুষ্ঠান ও প্রার্থনাঘরে গান পরিবেশন করতেন। বৈতালিক ও মন্দিরে সংগীত পরিবেশনের দায়িত্বও বেশির ভাগ সময় তাঁর ওপরই বর্তাত। তখন শ্যামা, চণ্ডালিকা ও তাসের দেশ নাটকের মহড়া হতো উত্তরায়ণে। স্বয়ং কবিগুরু উপস্থিত থাকতেন এসবের মহড়ায়। এই সময় কবিগুরুর পরম সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য হয় আবদুল আহাদের।
১৯৪১ সালের ২২ শ্রাবণ কবিগুরুর প্রয়াণ-সংবাদ শান্তিনিকেতনে পৌঁছার পর শৈলজারঞ্জন মজুমদার তাঁকে ডেকে নিয়ে সমবেত কণ্ঠে গাওয়ার জন্য একটি গানের স্বরলিপি দেন। বিখ্যাত সেই গানটি ছিল ‘সম্মুখে শান্তি পারাবার’। শান্তিনিকেতনের প্রার্থনাঘরে সেদিন সন্ধ্যায় সবাই মিলে তাঁরা গানটি গেয়েছিলেন।
শান্তিনিকেতনের শিক্ষাজীবন শেষে তিনি বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে যান। সেখানে কিছুদিন থাকার পর আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। এবার তিনি গ্রামোফোন কোম্পানি হিজ মাস্টার্স ভয়েজে রবীন্দ্রসংগীতের প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তাঁর নিবিড় তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেন তখনকার প্রখ্যাত সব শিল্পী। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সুধা মুখার্জি, সন্তোষ সেনগুপ্ত, সুচিত্রা মিত্র, পঙ্কজকুমার মল্লিক, শান্তিদেব ঘোষ, সত্য চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
আবদুল আহাদের নিজের সুরারোপিত প্রথম আধুনিক গানের রেকর্ড এইচ এম ডি থেকে বের করেন সন্তোষ সেনগুপ্ত। গান দুটি ছিল, ‘তুমি আমি দুই তীর সুগভীর তটিনীর’ ও ‘সে পথ ধরি আস নাই আস নাই তুমি’।
১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি আবদুল আহাদ ঢাকায় চলে আসেন। এরপর শুরু হয় তাঁর সাংগীতিক জীবনের নতুন অধ্যায়। ঢাকায় এসে তিনি যোগ দেন পাকিস্তান রেডিওর ঢাকা কেন্দ্রে। ঢাকা বেতার কেন্দ্রের তখন শোচনীয় অবস্থা। তাঁকে নিয়ে প্রযোজকের সংখ্যা তখন মাত্র তিনজন। ফলে এখান থেকে সংগীত সম্প্রচারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর ওপর। পাকিস্তান হলেও ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতিদিনের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ানোর ব্যাপারে তাঁর ছিল উদ্যোগী ভূমিকা।
আবদুল আহাদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১৮ সালে, রাজশাহীতে। তাঁর বাবা আবদুস সামাদ, মা হাসিনা খাতুন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন জ্যেষ্ঠ। তাঁর আদি পৈতৃক নিবাস ফরিদপুরে। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পাবনায় নানার বাড়িতে। আবদুল আহাদ জীবনের প্রায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বেতারে প্রযোজক-সুরকার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বয়সসীমা শেষ হওয়ার পরও সাতবার তাঁর চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল।
আবদুল আহাদ ছিলেন খুবই আত্মপ্রচারবিমুখ একজন সংগীত অন্তঃপ্রাণ মানুষ। সংগীতই ছিল তাঁর সারা জীবনের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘যে গানের মধ্য দিয়ে জীবনের উন্মেষ হয়েছিল, সেই গানই ছিল আমার পাথেয় এবং কর্মজীবনের সম্বল।’
গতকাল (১৪ মে) ছিল তাঁর ষোড়শ মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যুতেই মানুষের সব নিঃশেষ হয়ে বা ফুরিয়ে যায় না। কেউ কেউ বেঁচে থাকেন মৃত্যুর পরও। আবদুল আহাদও তেমনি একজন। তাঁর নাম গুঞ্জরিত হবে যতদিন থাকবে বাংলা গান।

No comments

Powered by Blogger.