কালো অধ্যায় ভুলতে চায় আলজেরিয়া by মাহফুজার রহমান

বেশি না, মাত্র বছর পাঁচেক আগেও সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকত আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সের সাধারণ মানুষ। যেকোনো সময় শহরের যেকোনো স্থানে বোমার বিস্ফোরণ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। রাজধানীর সড়ক থেকে প্রায় প্রতিদিনই মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার হতো। গলা কেটে হত্যা ছিল গৃহযুদ্ধকালীন এক সাধারণ ঘটনা।


নিরাপত্তার অভাবে সাধারণ মানুষ সন্ধ্যার পরে পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হতো না।
দেশটিতে ওই সময়ের সহিংসতার ধরন ও মাত্রা তুলে ধরতে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সহিংসতার বছরগুলোতে বাজারে আলু খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর। কারণ আলু চাষে যে সার লাগে, তা ঘরে তৈরি বোমা বানাতে ব্যবহার করা হতো বলে সরকার সারটি নিষিদ্ধ করে। তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ওসামা বিন লাদেনের সংগঠন আল-কায়েদার স্থানীয় শাখা আলজিয়ার্সের কোথাও না কোথাও হামলা চালাত।
জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো সরকারের সঙ্গে লড়তে লড়তে এখন অনেকটাই কোণঠাসা। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে সরকার আলজিয়ার্সসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করে। শহরে মোতায়েন করা হয় অসংখ্য সশস্ত্র পুলিশ। তারা পথে পথে মোটরবাইক নিয়ে টহল দেয়। রাস্তার ১০০ মিটার পর পরই পাহারা দেয় পুলিশ। বিবিসির সাংবাদিক ক্লো আর্নল্ডের মন্তব্য, তিনি দুনিয়ার আর কোথাও এ রকম নিরাপত্তার কড়াকড়ি দেখেননি।
বিবিসির সাংবাদিক বাড়িয়ে বলেননি মোটেই। আলজিয়ার্সে বিভিন্ন দূতাবাস, সরকারি বিভিন্ন ভবন ও মন্ত্রণালয়গুলোর ফটক নির্মিত হয়েছে পুরু ইস্পাতে। সীমানা দেয়াল দোতলা বাসের চেয়েও উঁচু! দেয়ালের ওপরে আবার কাচের টুকরো বা করাতের মতো খাঁজকাটা লোহার পাত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুটিই।
সরকারের এই পদক্ষেপে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টেছে অনেক। খুন, হামলা, সহিংসতার ঘটনা কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এখন আলজিয়ার্সে অনেক রাত পর্যন্ত ক্যাফে, দোকানপাট খোলা থাকে। কয়েক বছর আগেও বিষয়টি ছিল একেবারেই অচিন্তনীয়।
আফ্রিকা মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ আলজেরিয়ায় ১৯৯১ সালে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী সরকারবিরোধী তৎপরতা শুরু করে। সরকারও জঙ্গি দমনে অভিযান শুরু করে। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। পরে ১৯৯৭ সালে ‘ইসলামিক স্যালভেশন আর্মি’ (এআইএস) একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। আর ২০০২ সালে সরকারের কাছে পরাজিত হয় ‘আর্মড ইসলামিক গ্রুপ’ (জিআইএ)। তার পরও ছোট ছোট কিছু জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতার কারণে রাজধানী আলজিয়ার্সে সহিংসতার লাগাম যেন টেনে ধরা যাচ্ছিল না।
পরিস্থিতির যখন এভাবে অনেকটাই উন্নতি হয়েছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রে এক বিমান-সন্ত্রাসের চেষ্টাকে কেন্দ্র করে কালো তালিকাভুক্ত করা হয় আলজেরিয়াকে। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর এক নাইজেরীয় যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েটগামী একটি বিমান উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে মার্কিন সরকার নাইজেরিয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলজেরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক ও পাকিস্তানকে কালো তালিকাভুক্ত করে। এর ফলে এই দেশগুলোর নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চাইলে বিমানবন্দরে অন্য যেকোনো দেশের মানুষের তুলনায় অনেক বেশি তল্লাশির সম্মুখীন হতে হতো। তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের ওই কালো তালিকার উদ্যোগে। এত চেষ্টার পর নিরাপত্তা পরিস্থিতি যখন আগের তুলনায় অনেক ভালো, তখন এই মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তাদের চরম হতাশ করে।
বিবিসির ওই সাংবাদিকের পরিচিত আলজিয়ার্সের বাসিন্দা কারিমার প্রতিক্রিয়া ছিল দেখার মতো। কারিমা তাঁকে বলেন, ‘এটা একটা অপমানজনক ব্যাপার। মার্কিন সরকার আলজেরিয়ার নাম ওই তালিকা থেকে বাদ না দিলে আমি যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিসীমানায় যাব না।’ কালো তালিকাভুক্তির প্রতিবাদ জানাতে আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশটিতে নিযুক্ত মার্কিন দূতকে ডেকে পাঠান। পরে একপর্যায়ে মার্কিন সরকার ওই তালিকা থেকে আলজেরিয়ার নাম বাদ দেয়।
ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠছে আলজেরীয়রা। গৃহযুদ্ধ আর সহিংসতার ‘কালো বছরগুলো’ পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়াই এখন তাদের একমাত্র চাওয়া।
আলজিয়ার্সের এক মুদির দোকানে কাজ করেন ফারুক। সহিংসতার বছরগুলোতে যুক্তরাজ্যের একটি রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে কাজ করতেন তিনি। এখন দেশে ফিরেছেন। তাঁর মতো এমন অনেকেই বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরছেন মাতৃভূমিতে। ফারুক বলেন, ‘আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। সহিংসতাপীড়িত ভূখণ্ড হিসেবে নয়, আলজেরিয়াকে বিশ্বের কাছে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে চাই।’
আগামী জুনে দক্ষিণ আফ্রিকায় শুরু হতে যাওয়া বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেবে আলজেরিয়া। দেশটি যখন বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে, তখন বিশেষ করে তরুণসহ লাখ লাখ মানুষ আনন্দ-উল্লাস করে। সহিংসতার বছরগুলোতে জন্ম নেওয়া অনেক কিশোর-তরুণের জন্যই হয়তো নিজেদের আলজেরিয়ান ভেবে গর্ব বোধ করার প্রথম সুযোগ ছিল সেটা। সূত্র: বিবিসি।

No comments

Powered by Blogger.