শিক্ষা ক্যাডার-পৃথক কর্মকমিশন গঠন ও শঙ্কা by পুলক চাকমা

মহাজোট সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা শিক্ষায় অগ্রগতি। বিগত বছরের তুলনায় এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফলতার হার এর বড় দৃষ্টান্ত। বহু প্রতীক্ষিত শিক্ষানীতি-২০১০ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নিঃসন্দেহে নতুন উদ্যম সৃষ্টি করেছে।


এ নীতিতে সমন্বিত শিক্ষা আইন, স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন, বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠন করার কথা উল্লেখ থাকলেও শিক্ষক নিয়োগে পৃথক কর্মকমিশনের কথা উল্লেখ ছিল না। তবে সংবিধানের ১৩৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি দুটি সরকারি কর্মকমিশন গঠন করতে পারেন। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের ৮ এপ্রিল সরকারি কর্মকমিশন আদেশ জারির মাধ্যমে ‘সরকারি কর্মকমিশন (প্রথম)’ ও ‘সরকারি কর্মকমিশন (দ্বিতীয়)’ নামে দুটি কর্মকমিশন গঠন করা হয়েছিল। পরবর্তী সময় ১৯৭৭ সালে আরেক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এই দুটি কমিশনকে একীভূত করে নতুন একটি কর্মকমিশন গঠন করা হয়, যেটি বর্তমানে ‘সরকারি কর্মকমিশন’ নামে পরিচিত।
সম্প্রতি কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ‘পৃথক সরকারি কর্মকমিশন’ গঠন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা যায় (সূত্র: সমকাল, ইত্তেফাক)। শিক্ষক নিয়োগে এই পৃথক সরকারি কর্মকমিশন গঠন নিয়ে শিক্ষক সমাজে ইতিমধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গেছে। প্রস্তাবিত সরকারি কর্মকমিশনের প্রধান কাজ হবে মূলত সরকারি কলেজসমূহের শিক্ষক, জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া। শুধু তা-ই নয়, অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন প্রশিক্ষণকেন্দ্রের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদেরও এই কর্মকমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করা হবে বলে জানা যায়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রায় দুই বছর ধরে এই কর্মকমিশনের বিভিন্ন দিক যাচাই-বাছাই করার পর গত ৩০ এপ্রিল সচিব কমিটি এই প্রস্তাবটি অনুমোদন করেছে। এ কমিশনে একজন চেয়ারম্যান ও কমপক্ষে পাঁচজন সদস্য থাকবেন, তবে সদস্যসংখ্যা নয়জনের অধিক হবে না। অন্যদিকে বর্তমান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি কলেজে শিক্ষক নিয়োগদান ছাড়াও অন্যান্য পদে যেমন, সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক, সরকারি কলেজে ১০ শতাংশ কোটায় সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে নিয়োগ প্রদানসংক্রান্ত দিকগুলো সম্পন্ন করে থাকে।
২০১০ সালের ৩০ মে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় প্রথম ‘বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন’কে বিভক্ত করে ‘বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (সাধারণ)’ ও ‘সরকারি কর্মকমিশন (শিক্ষা)’ নামে দুটি কমিশন গঠনের প্রাথমিক সিদ্বান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে এই সিদ্বান্তের পক্ষে অর্থ বিভাগ, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের মতামত দিয়েছে। এর পক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুক্তি হলো, একটি মাত্র কমিশনের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা নিয়োগে সুপারিশ, পদোন্নতি, চাকরিতে নিয়মিতকরণ, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ ও শৃঙ্খলা রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্মগুলো নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। যেহেতু প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুই বছর সময় লাগে। তাই শিক্ষা নিয়ে যদি আলাদা কমিশন গঠন করা হয়, তাহলে শিক্ষা বিভাগে গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু বিসিএস শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ‘বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি’ এ কমিশন সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেছে। সমিতির ভাষ্যমতে, স্বতন্ত্র কর্মকমিশন গঠন করা হলে ২৬টি ক্যাডারের সদস্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগের সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। বিসিএস শিক্ষা সমিতির মতে, ১৪শ, ১৬শ ও ২৪শ বিসিএসের মাধ্যমে যদি প্রতি ব্যাচে সহস্রাধিক শিক্ষক নিয়োগ সম্ভব হয়, তাহলে আন্তরিকতা ও আস্থা থাকলে ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে। কারণ, প্রস্তাবিত কর্মকমিশনের মাধ্যমে বিসিএস শিক্ষক নিয়োগদান শুরু হলে এতে সিনিয়র সার্ভিস পুলের পদে নিয়োগের সময় সম-ব্যাচভিত্তিক সিনিয়রিটি নির্ধারণে জটিলতা তৈরি হবে। শিক্ষা সমিতি আরও মনে করে যে বর্তমান কাঠামোয় প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো সম্ভব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, নতুন নতুন পদ সৃষ্টি করা ও বিদ্যমান পদসমূহ আপগ্রেড করা। ১৯৮৩ সালের এনাম কমিটি ও ১৯৮৭ সালের সচিব কমিটির সুপারিশেও শিক্ষা ক্যাডারের মহাপরিচালক (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর), অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদের বেতন স্কেল আপগ্রেড করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এ ছাড়া নূর খান শিক্ষা কমিশন, কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশেও একই প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও নেপের (জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি) মহাপরিচালক, পরিচালক ও অন্যান্য পদসমূহ শিক্ষা ক্যাডারের শিডিউলভুক্ত পদ হলেও এসব পদসমূহে শিক্ষা ক্যাডার থেকে নিয়োগের অনুপাত খুবই কম।
পরিশেষে আলোচিত পর্যালোচনা থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে প্রস্তাবিত কর্মকমিশন গঠন নিয়ে শিক্ষক সমাজে একটি প্রচ্ছন্ন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ, এই কর্মকমিশনের গঠনের উদ্দেশ্য শিক্ষার মৌলিক সংস্কার ও শিক্ষা ক্যাডারের ভবিষ্যৎ নির্ধারণী সংক্রান্ত হলেও এ বিষয়ে শিক্ষক সমাজের বৃহত্তর অংশের সঙ্গে আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে বলে জানা যায়নি। শিক্ষক সমাজ মনে করে, সরকারের এ উদ্যোগটি অবশ্যই শিক্ষার স্বার্থে একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এতে শিক্ষক সমাজের সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শিক্ষার চলমান সফলতাকে ধরে রাখতে হলে শিক্ষকদের অবদানকেও সমানভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাই প্রস্তাবিত কর্মকমিশন নিয়ে বর্তমানে শিক্ষক সমাজে যে শঙ্কার মেঘ জমেছে তা দূর করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
পুলক চাকমা: শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা
pulakchakma21@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.