শুল্ক বৈষম্যের কারণেই বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা

পাঁচ বছরের পুরনো ১৫০০ (সিলিন্ডার ক্যাপাসিটি) সিসির একটি গাড়ির শুল্ক সাড়ে ১৪ লাখ টাকা। আর একই সিসির নতুন একটি গাড়ির শুল্ক ৯ লাখ। ছোট গাড়ির বিকল্প হিসেবে উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যে ধরনের অত্যাধুনিক বাস দরকার, সে রকম একটি বাসের দাম আড়াই কোটি টাকা।


অথচ আমদানির শর্তে বাড়তি আরেকটি বছর যোগ করলে ৯০ শতাংশ কম দামে অর্থাৎ ২৫ লাখ টাকায় ওই একই বাস পাওয়া যেত।
শুল্ক ব্যবস্থায় এ ধরনের নানা অসংগতি ও বৈপরীত্যের কারণে গাড়ির ওপর পৃথিবীর সর্বোচ্চ শুল্ক নির্ধারণ করেও সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ছে না, রাজধানীর রাস্তায় ছোট গাড়ির সংখ্যাও কমছে না, উন্নতমানের গণপরিবহন ব্যবস্থাও গড়ে উঠছে না বলে মনে করছেন গাড়ি আমদানিকারকরা। সব ধরনের মানুষের উপযোগী পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য তাঁরা গাড়ি আমদানির জন্য একটি সুষম শুল্কহার ও নীতি প্রণয়নের প্রস্তাব করেছেন সরকারের কাছে। যানজট দূর করে গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করার পরামর্শও দিয়েছেন তাঁরা।
গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার মতে, শুল্ক বৈষম্যের কারণে বাজারে পুরনো গাড়ির চেয়ে নতুন গাড়ির দাম কম। নতুন গাড়ির ইনভয়েসে কম মূল্য দেখানোর কারণে এটি সম্ভব হচ্ছে। ফলে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি নতুন গাড়ির নামে রাস্তায় নামছে জ্বালানি অপচয়কারী নিম্নমানের সস্তা গাড়ি। গাড়ির ওপর সর্বোচ্চ শুল্ক ৮২৯ শতাংশ। আমদানিকারকদের দাবি, পৃথিবীর কোনো দেশে গাড়িতে এত বেশি শুল্ক নেই। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল যানজট নিরসনের জন্য শহরে ছোট গাড়ির সংখ্যা কমানো। কিন্তু ভালোমানের জাপানি পুরনো (রিকন্ডিশন্ড) গাড়ির সংখ্যা কমলেও বেড়ে গেছে কম দামি নিম্নমানের গাড়ির সংখ্যা।
বিদ্যমান শুল্কনীতিতে সরকার, ক্রেতা, সাধারণ যাত্রী ও ব্যবসায়ী- কারোরই লাভ হয়নি বলে দাবি বারভিডার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে আমদানিকারকদের এ সংগঠন বলেছে, ভ্রান্তনীতির কারণে গাড়ি আমদানি থেকে সরকারের আয় কমে অর্ধেকে নেমেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে এ খাত থেকে রাজস্ব আয় ছিল তিন হাজার ৭৬ কোটি টাকা, ২০১০-১১ সালে তা নেমেছে এক হাজার ৭৮০ কোটি টাকায়। চলতি অর্থবছরের ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) গাড়ি আমদানি থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে এক হাজার ৯০ কোটি টাকা।
সামাজিক মর্যাদা, দীর্ঘস্থায়িত্ব ও পুনঃবিক্রয় মূল্য (রিসেল ভ্যালু) বিবেচনায় জাপানের রিকন্ডিশন্ড গাড়ি উচ্চমধ্যবিত্তের পছন্দের তালিকার শীর্ষে। বেশি শুল্ক ও কম অবচয় সুবিধার কারণে এ ধরনের গাড়ির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। শুধু দামের ব্যবধানের কারণে ক্রেতারা এখন ভারতসহ অন্য কয়েকটি দেশে তৈরি নতুন গাড়ির দিকে ঝুঁকছেন। বারভিডার হিসাবে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি হয়েছিল ৩৩ হাজার ১৭৮টি, পরের বছর এ সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ২২৫, গত অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ১৯ হাজার ৮২৩টিতে। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি হয়েছে সাত হাজার ৯৮৬টি।
বারভিডার সাবেক সভাপতি এবং অটোমিউজিয়াম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিব উল্লাহ ডন বলেন, রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমেনি, কমেছে ভালোমানের রিকন্ডিশন্ড জাপানি গাড়ির সংখ্যা। পরিবেশের ব্যাপারে জাপানিদের সচেতনতা ও সংবেদনশীলতা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। সুনামির পর তেজস্ক্রিয়তার আশঙ্কায় তারা অনেক গাড়ি ধ্বংস করেছে। আগে জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি দেশের চাহিদার ৯০ শতাংশ পূরণ করত, গত দুই বছরে এ হার নেমে এসেছে ৩০ শতাংশে। গাড়ির বাজারের ৭০ ভাগই চলে গেছে নিম্নমানের নতুন গাড়ির কাছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, প্রতিদিন রাজধানীর রাস্তায় ১৮০টি গাড়ি নামছে। আমদানিকারকদের দাবি, এর মধ্যে ১২৬টিই নতুন গাড়ি।
অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার আবদুল হামিদ শরীফ বলেন, 'এসব নতুন গাড়ির মান পরীক্ষিত নয়, এর ফুয়েল ইকনোমি, ফিটনেস নিয়েও কেউ নিশ্চিত নয়। জাপানের গাড়ি যে পরিবেশবান্ধব- এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকা অমূলক। কিন্তু অন্যান্য কয়েকটি দেশ থেকে আনা তথাকথিত নতুন এসব গাড়ি পরিবেশের জন্য নতুন করে হুমকি সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে ডিজেলচালিত ১৪০০ সিসির যে গাড়িগুলো আনা হচ্ছে, সেগুলো একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর কোথাও চলে না। অথচ ভর্তুকি মূল্যের ডিজেলে চলছে এ গাড়ি। আমি পরিবেশমন্ত্রীর কাছেও বিষয়টি উত্থাপন করেছি।' ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিসের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কয়েক বছর আগে আমদানি করা গাড়িগুলোর বর্তমান হাল উল্লেখ করে শরীফ বলেন, নতুন এ গাড়িগুলো ক্রেতারা বেশি দিন ব্যবহার করতে পারবেন বলে মনে হয় না।
নিম্নমানের নতুন গাড়ি আমদানি নিরুৎসাহ করা, ভালোমানের পুরনো গাড়ি আমদানি সহজ করা ও উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষের ব্যবহার উপযোগী উন্নত বাস সার্ভিস গড়ে তোলার জন্য শুল্ক কাঠামোয় কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে বারভিডা। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ার পাশাপাশি রাস্তায় ছোট গাড়ির সংখ্যা সীমিত থাকবে, গণপরিবহন ব্যবস্থাও উন্নত হবে বলে তাদের বিশ্বাস।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে দেওয়া প্রস্তাবে বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা) বলেছে, বর্তমানে সিটি সার্ভিসে যেসব বড় বাস ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলোতে উচ্চমধ্যবিত্ত ও ধনী শ্রেণীর মানুষ যাতায়াত করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস চালু হলেও ভ্রান্তনীতির কারণে তা বিলুপ্ত হতে চলেছে। এই শ্রেণীর যাত্রীদের ভ্রমণের উপযোগী বাস না থাকায় রাস্তায় প্রাইভেট কার বাড়ছে। এদের বাসে চলাচলে উদ্বুদ্ধ করতে হলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) উন্নতমানের বাস চালু করতে হবে।
কিন্তু বিদ্যমান শুল্ক কাঠামোয় একটি আধুনিক বাসের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। গণপরিবহনে এত দামি বাস যুক্ত করলে বিনিয়োগ অনুযায়ী যাত্রীভাড়া অনেক বেশি আদায় করতে হবে, যা আমাদের দেশের বাস্তবতায় সম্ভব নয়। কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শুল্কহ্রাস সুবিধায় জাপানের তৈরি অত্যাধুনিক এসি বাস আমদানি বয়সসীমা ১০ বছর করা হলে নতুন গাড়ির দামের ১০ শতাংশ দামে অর্থাৎ ২৫ লাখ টাকায় সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব বাস আমদানির পথ সুগম হবে। উন্নত শ্রেণীর এ বাস সার্ভিসে যাত্রীরা রিকশার চেয়েও কম ভাড়ায় চলাচল করতে পারবেন। নিউজিল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ অনেক দেশেই এভাবে উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।
বারভিডার মতে, এসব জাপানি বাস নির্বিঘ্নে বাংলাদেশে আরো ২০ বছরেরও বেশি চলাচল করতে পারবে, যা মহানগরীর গণপরিবহন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।
রিকন্ডিশন্ড গাড়ির অবচয় সুবিধা পাঁচ বছরের জন্য ৬০ শতাংশ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে বারভিডা। সংগঠনটি বলেছে, বর্তমানে অবচয় সুবিধা রয়েছে তিন বছরের জন্য ৩৫ শতাংশ, কিন্তু আমদানি হচ্ছে পাঁচ বছরের পুরনো গাড়িও। এই সুযোগে নতুন গাড়ির ক্ষেত্রে আন্ডার-ইনভয়েসিং করে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। ফলে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির চেয়েও নতুন গাড়ির শুল্ক কম হচ্ছে। ডলার ও ইয়েনের মূল্য বৃদ্ধি এবং ন্যায্য হারে অবচয় না পাওয়ায় রিকন্ডিশন্ড গাড়ির আমদানি ৩০ শতাংশে নেমেছে।
নতুন গাড়ির শুল্কমূল্য নির্ধারণের পদ্ধতির কারণেও এ খাতে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে বারভিডা। সংগঠনটি বলেছে, উৎপাদনকারী নিয়োজিত ডিলারের সংখ্যা বাংলাদেশে খুবই নগণ্য। বেশির ভাগ ডিলারই তৃতীয় কোনো কম্পানির মাধ্যমে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নতুন গাড়ি আমদানি করছে এবং সেই তৃতীয় কম্পানির দেওয়া ইনভয়েস ভ্যালুকে ঘোষিত মূল্য ধরে শুল্ককর পরিশোধ করা হচ্ছে। এর ফলে সরকার বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে, অবৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হচ্ছে। একই সঙ্গে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ব্যবসায়ীরা নতুন গাড়ির ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছেন।
সব ধরনের মোটরগাড়ি ও মাইক্রোবাসের শুল্কায়নের স্তর বিন্যাসেও পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে বারভিডা। এক হাজার সিসি পর্যন্ত গাড়ির সম্পূরক শুল্ক ৩০ শতাংশ রেখে, ১৮০০ সিসি পর্যন্ত ৪৫ শতাংশ, ২৫০০ সিসি পর্যন্ত ১০০, তিন হাজার সিসি পর্যন্ত ২৫০, ৩৫০০ সিসি পর্যন্ত ৩৫০ ও এর ওপরে ৫০০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। এতে মজবুত, দীর্ঘায়ু, উন্নতমানের গাড়ি সুলভ মূল্যে পাওয়া যাবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি সরকারের রাজস্বও বাড়বে বলে দাবি করে তারা। যুক্তি হিসেবে তারা বলে, জাপানে একই আয়তনের প্রায় সব মডেলের গাড়ি ১৫০০ থেকে ১৮০০ সিসির মধ্যে। শুল্ক স্তর বিন্যস্ত করলে বেশি সিসির গাড়িও কম দামে পাওয়া যাবে। উদাহরণ দিয়ে বারভিডা বলেছে, জাপানে তৈরি ২০০৭ মডেলের ১৫০০ সিসির একটি করলা গাড়ি কিনতে হচ্ছে ১০ হাজার ডলারে, আর ১৮০০ সিসির ২০০৬ মডেলের একটি গাড়ির দাম ছয় হাজার ডলার।
বাণিজ্যিক গাড়ি হিসেবে শ্রেণীকৃত মাইক্রোবাসের ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ 'অযৌক্তিক' মন্তব্য করে বারভিডা বলেছে, অ্যাম্বুলেন্স, রেন্ট-এ-কার, কারখানার লোক পরিবহনের কাজে মাইক্রোবাস ব্যবহৃত হয়, এতে পরিবহন সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়। তাই মাইক্রোবাসে সম্পূরক শুল্ক থাকা উচিত নয়।
পণ্যের পরিবহন কমানোর জন্য রিকন্ডিশন্ড পিকআপ ও ট্রাকের আমদানি শুল্ক সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ এবং মাল্টি-এঙ্লে ট্রাক ও ডেলিভারি ভ্যানের আমদানি শুল্ক তুলে নেওয়ার পক্ষে বারভিডা। এর ফলে সুলভ মূল্যে যুগোপযোগী ট্রাক আমদানির সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং পণ্য পরিবহন খরচ কমবে।

No comments

Powered by Blogger.