কল্পকথার গল্প-ক্ষমতাধর তৃতীয় হাতের সন্ধানে... by আলী হাবিব

ভুলে যাওয়ার বা ভুল করার অর্থ কী? স্বাভাবিকভাবে অনেকেই ধরে নিতে পারেন, মনে না থাকাটা হচ্ছে ভুলে যাওয়া। কোনো কিছু করার কথা ছিল আপনার। করতে পারেননি। ভুলে গেছেন। মনে রাখতে পারেননি বলে সময়মতো কাজটি সম্পন্ন হয়নি। এটাই তো ভুল? স্বাভাবিক বিবেচনায় এটাই তো ভুলের সংজ্ঞা হতে পারে।


কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মনে না থাকা নয়, ভুলে যাওয়া হচ্ছে মনে না রাখা। তাঁরা বলছেন, মনে না থাকার কোনো কারণ নেই। মনে রাখতে না চাইলেই মনে রাখা যায় না। মনে রাখতে চাইলে ভুল হওয়ার বা ভুল করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই_এমনই যুক্তি দেখাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কোনো একজনকে কল্পনা করা যাক, যিনি ভুলে যান। অফিসে বের হওয়ার সময় স্ত্রী পইপই করে বলে দিয়েছেন, ফেরার পথে বাজার থেকে কী কী আনতে হবে। মাঝে দুইবার ফোনে সেটা মনেও করিয়ে দিয়েছেন। ভদ্রলোক এনেছেন। তবে সবগুলো আনেননি। কেন? অকপটে বলে দিলেন, ভুলে গিয়েছি। আসলে কিন্তু ভুলে যাননি তিনি; ভুলে থেকেছেন। ভুলে থাকতে চেয়েছেন। সোজা কথায়, মনে রাখতে চাননি তিনি; মনে রাখেননি। যখন প্রশ্নের মুখে পড়েছেন, তখন বলে দিয়েছেন, তিনি ভুলে গেছেন। এই ইচ্ছাকৃত ভুলে যাওয়া বা মনে রাখার ব্যাপারটিকে এককথায় বলা যায়_অজুহাত। আমাদের প্রত্যেকের দুটি করে হাত আছে। কিন্তু আরেকটি অদৃশ্য হাত আছে আমাদের_অজুহাত। অদৃশ্য এই তৃতীয় হাত, অর্থাৎ অজুহাত নিয়ে আমরা গর্ব করতেই পারি। যখন যেভাবে পারা যায়, অজুহাত খাড়া করতে আমরা একটুও পিছপা হই না। কোথাও যাওয়া হয়নি, অজুহাত খাড়া। কিছু করা হয়নি, অজুহাত খাড়া। কাজের কাজটি ফেলে অকাজে সময় নষ্ট হয়েছে, অজুহাত খাড়া। বাঙালির একটা দুর্নাম আছে_আমরা নাকি দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝতে পারি না। কিন্তু অজুহাতের অমর্যাদা বোধ হয় বাঙালি কোনো দিন করেনি। এই একটি জায়গায় বাঙালির দক্ষতার প্রশংসা না করে পারা যাবে না। বরং এই তৃতীয় হাত, অর্থাৎ অজুহাতের ব্যবহার বাঙালির চেয়ে ভালোভাবে, সুন্দরভাবে আর কেউ কোথাও করতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
বাঙালির আর সব হাতের তুলনায় অজুহাতের শক্তি বেশি। কারণে-অকারণে আমরা আকাশের দিকে দুই হাত তুলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করি, 'অমুকের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও'। কিন্তু নিজেদের অজুহাত ভাঙার জন্য কেউ সচেষ্ট নই। বরং সযত্নে রক্ষা করে চলি অজুহাতকে। অজুহাত থাকার অনেক সুবিধা। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, কারণে-অকারণে অজুহাত খাড়া করতে আমাদের জুড়ি নেই। মানুষের, বিশেষ করে বাঙালির এক যুগান্তকারী আবিষ্কার এই অজুহাত। প্রয়োজনেই অজুহাত আবিষ্কৃত হয়েছে। অজুহাত যদি না থাকত, তাহলে পথে-ঘাটে, এখানে-সেখানে, ঘরে-বাইরে আমাদের যে কতভাবে নাজেহাল হতে হতো, তার ইয়ত্তা নেই। কতভাবে, কত জায়গায়, কত রকম অজুহাত যে আমরা খাড়া করি, তার হিসাব কি আমরা নিজেরাও রাখি? রাখি না। ধনী আত্মীয়ের বাড়িতে বিয়ের দাওয়াত। কিন্তু পকেটের অবস্থা খারাপ। ভুলে যাওয়ার কথা বলা যাচ্ছে না। অজুহাত একটা খাড়া করে দিলেই হলো। বলে দিন, অফিসে আটকা পড়েছিলেন; বিকেলে বের হতে পারেননি। ফলে যাওয়া হয়নি। আজকাল তো একটা বড় অজুহাত হয়েছে জ্যাম। আপনার কোথাও যাওয়ার কথা। যাবেন না কিংবা আড্ডায় বসে সময়মতো সেখানে যাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। মনে হতেই রওনা হয়েছেন সেদিকে। ততক্ষণে ঘণ্টাখানেক সময় চলে গেছে। তিনি ফোন করেছেন। অজুহাত খাড়া করে দিন। বলে দিন, জ্যামে আটকে আছেন। কারো কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন। সময়মতো সেই টাকা ফেরত দেওয়া হয়নি। পাওনাদার যে রাস্তায় চলাচল করে, সেই রাস্তা এড়িয়ে চলেন। তার ফোন ধরেন না। হঠাৎ একদিন মুখোমুখি পড়ে গেলেন। কী করবেন? অজুহাত খাড়া করে দিন। বলে দিন, ভুলে গিয়েছিলেন। ভুলে যাওয়াটাও একটা অজুহাত। আবার, হয়তো এমন কোথাও বাধ্য হয়ে যেতে হবে, যেখানে যেতে চান না আপনি। সেখানে যাবেন না, এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছেন। বাড়ি থেকেও বেরিয়েছেন। কিন্তু বন্ধুদের আড্ডায় বসে যান। সেখান থেকে ফোন করে বলে দিন, জ্যামে আটকা পড়ে মাঝপথে গাড়ি থেকে নেমে যেতে বাধ্য হয়েছেন; যেতে পারছেন না। এভাবে একটার পর একটা অজুহাত খাড়া করতে থাকুন। অজুহাত আবিষ্কার করুন। আবিষ্কার করুন নিজেকেও। ধরুন, আপনি কোনো অফিসে কাজ করেন। সেখানে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কাজ করতে হয়। তাতে সহকর্মীদের অনেকেই আপনার ওপর রুষ্ট। অজুহাত খাড়া করে দিন। বলুন, বড় কর্তা আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনাকে দিয়ে এসব কাজ করাচ্ছেন; আপনার কিছু করার নেই। আপনার অবস্থা, 'যেমনি নাচাও তেমনি নাচি' জাতীয়। দেখবেন, এই এক অজুহাতে সহকর্মীরা আপনার সহমর্মী হয়ে উঠেছেন। যে ক্ষোভ তাঁদের ছিল, সেটা আপনার দিক থেকে ঘুরে বড় কর্তার দিকে চলে যাবে। আপনি থেকে যাবেন নিরাপদ দূরত্বে। খেলার মাঠে প্রতিপক্ষের সামনে টিকতে পারেনি দল। অজুহাত খাড়া করতে নিষেধ কোথায়? দিনটি আজ আমাদের ছিল না_এর চেয়ে ভালো অজুহাত আর কী হতে পারে?
এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যে ক্ষেত্রে অজুহাত দেওয়া যায় না। বিদ্যুৎ দেওয়া যাচ্ছে না কেন? ব্যবহার বেড়ে গেছে। গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না কেন? সংকট আছে। অপরাধ দমন করা যাচ্ছে না কেন? পুলিশের সংখ্যা কম। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে কেন? মোক্ষম অজুহাত_সিন্ডিকেট। টিসিবিকে সক্রিয় করা যাচ্ছে না কেন? এখানে বোধ হয় অজুহাত খাড়া করা যাবে না। যেখানে সদিচ্ছার অভাব, সেখানে তো আর অজুহাত খাড়া করা যায় না।
আপনি কি রাজনীতি করেন? এখানেও অজুহাত আপনাকে রাখবে নিরাপদ। সময়মতো সঠিক অজুহাত তুলে ধরতে পারলে আপনি নিরাপদে থাকবেন। হয়তো রাজনীতির মাঠে এমন কিছু করতে হয়েছে, যা আপনার চরিত্রের সঙ্গে যায় না। আপনি যা করেছেন, সেটাকে রাজনৈতিক নোংরামিই বলা চলে। অজুহাত খাড়া করে দিন। অন্তত আত্মপক্ষ সমর্থন তো করা যাবে। একের পর এক যত অজুহাত খাড়া করতে পারবেন, রাজনীতিতে আপনার দক্ষতা ততই প্রশংসিত হবে। আজকাল তো হামেশাই এমন অজুহাত খাড়া করা হচ্ছে। চাপানউতোরের পাশাপাশি চলছে অজুহাত খাড়া করা। 'মানি না, মানব না' বলে আকাশের দিকে হাত যেমন উঠছে, তেমনি উঠছে অজুহাত। স্বাধীনতার মাস এসে গেছে। একাত্তরের এই মাসের শুরুতে নানা অজুহাতে বাঙালির অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। নানা অজুহাতে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি বাঙালির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে। অনিবার্য কারণেই শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার জন্য শামিল ছিল দেশের মানুষ। কিন্তু দেশেরই কিছু মানুষ দেশের স্বাধীনতা চায়নি। দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতেও বাধেনি তাদের। একাত্তরের সেই যুদ্ধাপরাধীদের স্বাধীনতার পর দেশের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইঁদুর যেমন গর্তে লুকায়, তেমনি অজ্ঞাতবাসে চলে যাওয়া একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা বেরিয়ে আসতে থাকে পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। একাত্তরে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণের পক্ষে এখন তাদের অজুহাত আছে। সময়-সুযোগ বুঝে সেই অজুহাত খাড়া করতে তাদের একটুও বাধে না এখন। তাদের মুখে এখন একটাই বুলি, একাত্তরে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যাওয়াটা ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াটা কতখানি নৈতিক ছিল, সেই প্রশ্নের জবাব তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। এখন সেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অজুহাতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায় থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে ব্যস্ত তারা। আবার, যুদ্ধাপরাধের বিচার চান না যাঁরা, তাঁদেরও অজুহাতের অন্ত নেই।
কাজেই অদৃশ্য এই তৃতীয় হাতের ক্ষমতা নিয়ে কারো দ্বিমত থাকার কোনো অবকাশ নেই। যার যার তৃতীয় হাত তৈরি রাখুন। ক্ষমতাধর এই হাতটি সময়মতো ব্যবহার করুন। দেখবেন, অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। অজুহাতের কল্যাণে নিজেকে অন্যদের চেয়ে যোগ্য মনে হবে। যদি এখনো এই হাতের ব্যবহার জানা না থাকে, যোগ্য গুরুর সন্ধান করে ব্যবহারটি শিখে নিন। কী বললেন, আপনার এই তৃতীয় হাতটি নেই? আছে। আপনি বাঙালি তো? তাহলে আপনারও এই ক্ষমতাধর তৃতীয় হাতটি আছে। আছেই। হয়তো সুপ্ত অবস্থায় আছে। লুপ্ত হওয়ার আগেই গুপ্ত এই ক্ষমতাধর হাতটি খুঁজে বের করুন। অনেক সমস্যার সহজ সমাধান চলে আসবে আপনার হাতের মুঠোয়।

লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.