খুন্তির ছেঁকা দেওয়া শিক্ষিকা গ্রেপ্তার

১৪ শিক্ষার্থীকে খুন্তির ছেঁকা দেওয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত মাদ্রাসাশিক্ষিকা জেসমিন আক্তারকে (৩৮) অবশেষে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে পুলিশ। ধরা পড়ার পর জেসমিন আক্তার অনুশোচনার স্বরে পুলিশকে বলেছেন, এই কাজ করা তাঁর ঠিক হয়নি। রাগের মাথায় তিনি এ ঘটনা ঘটিয়েছেন।
জেসমিন আক্তারকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে আদালতে পাঠায় পুলিশ। তবে আদালত রিমান্ড মঞ্জুর না করে কারাগারে পাঠিয়ে দেন বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কদমতলী থানার সাব-ইন্সপেক্টর শাকের মোহাম্মদ জুবায়ের।
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্র জানায়, পূর্ব নামা শ্যামপুরের 'তালিমুল কোরআন মাদ্রাসা' ১০ দিন বন্ধ থাকার পর খোলা হলে গত ১ মে ১৪ জন শিশু ছাত্রী মাদ্রাসায় হাজির হয়। এ সময় মাদ্রাসার শিক্ষিকা জেসমিন আক্তার উপস্থিত ছাত্রীদের জিজ্ঞাসা করেন, ছুটি থাকা অবস্থায় ছাত্রীরা সবাই নামাজ আদায় করেছে কি না? উত্তরে ছাত্রীরা বলে, তাদের দুই-এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা হয়েছে। জেসমিন আক্তার উত্তেজিত হয়ে ছাত্রীদের বলেন, 'আজ তোমাদের এমন শিক্ষা দেব যে আর জীবনে নামাজ কাজা করবে না।' তিনি গৃহকর্মী জান্নাতকে (১০) রান্নাঘরে খুন্তি গরম করতে বলেন। এরপর উপস্থিত ১৪ জন শিশু শিক্ষার্থীকে খুন্তি দিয়ে পায়ে ছেঁকা দেন। ছাত্রীরা মাদ্রাসা ছুটির পর বিষয়টি তাদের অভিভাবকদের জনালে এলাকার লোকজন ওই শিক্ষিকার ওপর ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা মাদ্রাসা ঘেরাও করে তাঁকে গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি করে। তবে এর আগেই জেসমিন আক্তার দ্রুত তাঁর স্বামী মাওলানা মাসুদুর রহমানকে নিয়ে পালিয়ে যান।
এদিকে এ ঘটনার পর ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস পাখির বাবা আবদুল জলিল বাদী হয়ে কদমতলী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা করেন। এরপর গত সোমবার জেসমিনকে গভীর রাতে ঢাকার নবাবগঞ্জের ছোট বঙ্নগর এলাকায় তাঁর খালার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে কদমতলী থানার পুলিশ।
কদমতলী থানার ওসি শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সময়মতো নামাজ না পড়া ও কাজা করার কারণ দেখিয়ে খুন্তি গরম করে ১৪ শিশু ছাত্রীকে ছ্যাঁকা দেন ওই অধ্যক্ষ। অধ্যক্ষের স্বামী মাসুদুর রহমানও ওই মাদ্রাসার শিক্ষক।'
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ঘটনার তদন্তে নেমে তাঁরাও অবাক হয়েছেন। পুলিশ গিয়ে দেখতে পায়, পূর্ব নামা শ্যামপুরে 'তালিমুল উলুম মহিলা মাদ্রাসা' নামের যে মাদ্রাসায় এ ঘটনা ঘটেছে, সেটি আসলে একটি বাড়ি। বাড়ির তৃতীয় তলার নির্মাণকাজ চলছে। দোতলার চারটি কক্ষ ভাড়া করে এর দুটি কক্ষে মাসুদুর রহমান ও জেসমিন আক্তার সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন। বাকি দুটি কক্ষকে শ্রেণীকক্ষ বানিয়ে সেখানে শিক্ষার্থীদের কায়দা ও কোরআন শেখানো হয়। সেটিকেই মাদ্রাসা বানিয়ে জেসমিন আক্তার স্বঘোষিত অধ্যক্ষ বনে যান। গ্রেপ্তারের পর জেসমিন পুলিশকে জানান, তাঁর মাদ্রাসায় আরো তিনজন শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু তাঁরা চলে যাওয়ার কারণে তিনি একাই শিশুদের পড়াচ্ছেন। তবে তিনি মাদ্রাসা করার কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। তিনি দাবি করেন, এই মাদ্রাসায় ৪০-৫০ জন শিশু ছাত্রী রয়েছে। ঘটনার দিন ১৪ জন উপস্থিত ছিল।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জেসমিন আক্তার জানিয়েছেন, গত তিন বছর ধরে বিভিন্ন এলাকায় তিনি বাসা ভাড়া নিয়ে কায়দা ও কোরআন পড়িয়ে আসছেন। পূর্ব নামা শ্যামপুরের এই বাসাটি ভাড়া নিয়েছেন গত রমজান মাসে। তখন থেকেই স্বামী-স্ত্রী তালিমুল কোরআন মহিলা মাদ্রাসা নাম দিয়ে এখানে শিশুদের পড়াচ্ছেন। মাসুদুর রহমান নামা শ্যামপুরের একটি মসজিদের ইমাম।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কদমতলী থানার সাব-ইন্সপেক্টর শাকের মোহাম্মদ জুবায়ের কালের কণ্ঠকে বলেন, শিশুদের প্রত্যেকের হাঁটু ও গোড়ালির মাঝামাঝি স্থানে ছ্যাঁকা দিয়েছেন জেসমিন আক্তার। জিজ্ঞাসাবাদের সময় জেসমিন আক্তার বলেছেন, প্রথমে একজনকে তিনি খুন্তির ছ্যাঁকা দেন। এরপর অন্যদের ছ্যাঁকা না দিলে বিষয়টি নিয়ে ঝামেলা হতে পারে- এই ভেবে তিনি এক-এক করে সবাইকে খুন্তির ছ্যাঁকা দেন। জেসমিন আক্তার আরো দাবি করেছেন, ছ্যাঁকা খাওয়ার পর শিশুরা চিৎকার করলে তাঁর মায়াও লাগে। তবে 'দোজখের আগুন' সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্যই তিনি খুন্তির ছ্যাঁকা দেওয়ার কথা চিন্তা করেন।

No comments

Powered by Blogger.