পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-সকলই গরল ভেল? by ফারুক ওয়াসিফ

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগে শান্তিও নেই, গতিও নেই। গতি না থাকলেও দুর্গতি আছে, উত্তেজনাও বিস্তর। বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বললে এখন আর বিদ্যার রাজত্বের কথা মনে পড়ে না। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে তাজা প্রাণ আর ঊর্ধ্বমস্তক নিয়ে যে শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে, দিন দিন তাদের মাথা হেঁট হতে থাকে।


কয়েক বছর পর ক্যাম্পাসের ক্ষমতাসৌধের সাত কুঠুরি নয় দরজা পেরিয়ে যখন সে আবার পৃথিবীর পথে নামে, তখন তার প্রাণশক্তি আর আত্মবিশ্বাসের সামান্যই অবশিষ্ট থাকে। যে জনগণের করের টাকা তার এই বৈতরণী পার হওয়ার পাথেয় জোগায়, সেই জনগণও দেখে খুব বেশি দেওয়ার ক্ষমতা নেই এসব নবীন স্নাতকের।
কিন্তু তাদেরও বলার আছে অনেক কিছু। সে দেখেছে, ঠিকমতো ক্লাস হয় না, বেশিরভাগ শিক্ষকই মহাজ্ঞানী-মহাজন নন। সে জেনেছে, তেল-তোয়াজ ছাড়া ভালো ফল করা যায় না। সে বুঝেছে, আত্মসম্মান রাখতে গেলে পদে পদে মার খেতে হয়। এবং অবশেষে সে মেনেছে: সার্টিফিকেটের কাগজটা বিদ্যার মেরু বা দণ্ড কোনোটাকেই জোরদার করে না। হাড়ে হাড়ে সে টের পায়, বিদ্যার সাধনা নিরর্থক, শিক্ষকতার সুযোগ খেয়ে যাবে ক্ষমতার মৌমাছিরা। এই ছেলে যদি সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত না হয়, এই মেয়ে যদি যৌননিপীড়নের শিকার না হয়, যদি সেই ছেলেকে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া না হয়, যদি তার পিটুনি-মৃত্যু না হয়; তাহলে তার অভিভাবক নিয়তির কাছে অশেষ শোকর গুজার করে। শিক্ষাজীবন মানে যেখানে জীবন খরচের ঝুঁকি, সেই বাস্তবতা দারুণ করুণ।
সেশনজটে ধুঁকতে ধুঁকতে অক্ষত অবস্থায় সার্টিফিকেট হাতে বের হতে পারাই এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পাবলিক’ লক্ষ্য। বিদ্যা-বুদ্ধি-গবেষণার দিশার জন্য এখন আর কেউ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে না। সেই প্রয়োজন মেটানোর ভরসা বিদেশ-ফেরত স্নাতকেরা। ভিন্ন সংস্কৃতির ভিন্ন প্রয়োজনে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁরা যে জ্ঞান আয়ত্ত করেন, তা দেশের মাটিতে ফলাতে তাঁদেরও বেগ পেতে হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী কিন্তু কম প্রশিক্ষিত শিক্ষার্থীদের সংগ্রাম বিদেশ-ফেরতদের থেকে কোনো অংশে কম না হলেও চাকরি ও গুরুত্বের বাজারে তারা প্রায়ই কমজোরি। এটা তাদের শ্রেণীগত পরাজয়কেও ডেকে আনে। সাধারণত দেশি স্নাতকদের বেশির ভাগই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর, আর বিদেশাগত স্নাতকেরা ওপর মহলের। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুরবস্থা এভাবে নিম্ন ও মধ্যশ্রেণীর সন্তানদের পিছিয়ে দেয়, তারা এলিট শ্রেণীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে পারে না। ব্যতিক্রম রইলেও এটাই মূল প্রবণতা।
মধ্যবিত্তরাই মূলত এই রাষ্ট্রের শিক্ষা ও সংস্কৃতি ও রাজনীতির প্রধান ভূমিকায় ছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাদের অনেকেরই উত্থানের মঞ্চ। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পত্তনের ইতিহাস আর আমাদের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত হওয়ার ইতিহাস প্রায় সমান্তরাল। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বঞ্চিত পূর্ব-বাঙালিদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। স্বাধীনতার আগে-পরে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সহায়ক হয়েছিল নতুন উঠে আসা মধ্যশ্রেণীর জন্য। তাদের এই আত্মপ্রতিষ্ঠার বাসনা আসলে জাতীয় সক্ষমতা কায়েমের রাস্তা ধরেই হাঁটছিল। কিন্তু আজকের দুর্গতি ও দুর্যোগের সময়ে সত্য হলো: ‘সুখেরও লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু/ অনলে পুড়িয়া গেল। অমিয় সাগরে সিনান করিতে/ সকলই গরল ভেল।’
‘রাজনীতির কবলে পড়ে এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো “ওয়াসা” অথবা “আদমজী” হয়ে পড়েছে?’ (মোহাম্মদ তানজীম উদ্দীন খান /bdnews24.com) নিদান হিসেবে কেউ রাজনীতি বন্ধ আর কেউ বেসরকারীকরণের কথা তুলতেও দ্বিধা করছেন না। রাজনীতি বন্ধ কিংবা আদমজীর মতো বন্ধ করা অথবা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মতো বেসরকারীকরণ যাঁরা চান, তাঁরা কি তাহলে মেনেই নিয়েছেন, যে রাজনৈতিক ও চিন্তাগত দিশার দায়িত্ব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়েছিল, সেই দায়িত্ব পালনের আর প্রয়োজন নেই? দেশের ভেতরের বাণিজ্যিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আমরা নেতৃত্ব ও চিন্তা আমদানি করব? এর সরকারি উত্তর হচ্ছে, ‘হ্যাঁ’।
দেশে ইদানীং লিডারশিপ প্রশিক্ষণ কিংবা নেতৃত্ব সম্মেলনজাতীয় এক ধরনের কর্মকাণ্ড চলে। মূলত ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করা, বিদেশ-ফেরত ব্যবসায়িক উদ্যোক্তারাই এসব সম্মেলন করেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতেও তাঁদেরই জয়জয়কার। এসবই ইঙ্গিত করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পদাবনতি হয়েছে। তাহলে উচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্ত কেরানি তৈরির কারখানা হওয়াই এগুলোর পরিণতি?
মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশ দেখে এ আশঙ্কাই জাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর ধরে গবেষণা খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের ১ শতাংশের কাছাকাছি। বিশ্বব্যাংকের উচ্চশিক্ষা সংস্কার কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, নিজস্ব আয় বাড়াতে। তার মানে, রাষ্ট্র আর উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়। তাদের আগ্রহ অন্যত্র। এ রকম অনাদর আর অবহেলার পরিবেশেই রাজনৈতিক দখলদারি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসে। উপাচার্যদের কারও কারও হাতে সেই খাঁড়া শোভা পাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখন দলীয় হাতিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল দলীয় শিক্ষক-প্রশাসক আর ছাত্রলীগের দলবাজির ইনাম। অনির্বাচিত উপাচার্যদের পদ ধরে রাখার যোগ্যতার সঙ্গে দলীয় মাস্তানের যোগ্যতার কোনো ফারাক থাকছে না। উভয়ই একই কাজ একই পদ্ধতিতে করে থাকেন। সেটা হলো: আনুগত্য, দুর্নীতি আর সন্ত্রাস, দখলদারি। জাবির প্রতিবাদী শিক্ষার্থীরা তাই সঠিকভাবেই দাবি তুলেছেন: দুর্নীতি, দখলদারি, সন্ত্রাস/শিক্ষাঙ্গন কারও জমিদারি নয়। তাঁরা ঘোষণা করেছেন: খুনিদের উল্লাসমঞ্চ আমার ক্যাম্পাস নয়।
তাঁদের এই দাবি এই ডাক, উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রগুলোকে দলীয় জমিদারি থেকে মুক্ত করার। এই দাবি ধ্বংসের দিকে রওনা হওয়া উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাণের ডাক, ডুবন্ত জাহাজের যাত্রীদের এসওএস বার্তা। দশকের পর দশকের অন্যায়-অনিয়ম, একের পর এক শাসকের রাজকীয় ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র, ছাত্র-শিক্ষকদের একাংশের মাধ্যমে আদর্শিক রাজনীতির জায়গায় দখলদারির রাজনীতি কায়েম এবং দেশের বিদ্বৎসমাজসহ অগ্রণী নাগরিকদের উদাসীনতাকে তাঁরা প্রশ্ন করছেন। শিক্ষা রাষ্ট্রের খাতে এবং সমাজের হাতে পরিচালিত হবে, এটাই বিশ্বজনীন নিয়ম। রাষ্ট্র যখন দায় অস্বীকার করে দূষণ ঘটাচ্ছে, তখন সমাজের মানুষেরা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? শিক্ষার্থীদের এই শিক্ষা বাঁচাও আন্দোলনকে তাই সফল করার দায়িত্ব গোটা সমাজের।
পুনশ্চ: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাবি ও বুয়েটের আন্দোলনকারী শিক্ষকদের ডেকে আশ্বাস দিয়েছেন, তিনি ইতিবাচক ব্যবস্থা নেবেন। তার মানে, বিশ্ববিদ্যালয়-সমাজের ডাক তিনি শুনেছেন। আমরা তাঁর আশ্বাসের মধ্যে শিক্ষার বিবেককে সোপর্দ করলাম এই আশায় যে, তিনি নিরাশ করবেন না। এই আন্দোলন ও এই আশ্বাস একসঙ্গে বিফল হলে সর্বনাশ।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.