হিট স্ট্রোক

‘ধর ধর! পড়ে গেল!’ ফরিদ চিৎকার করতে করতে ধরার আগেই সিট থেকে গড়িয়ে পড়লেন রিকশাওয়ালা চাচা। বেসরকারি সংস্থায় উচ্চপদে কর্মরত ফরিদ একটু ভিতু টাইপের, কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। তবে তাঁর চিৎকারে টিএসসির সামনে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা এগিয়ে এলেন।


চাচার মুখ দিয়ে গ্যাজলা বেরোচ্ছে আর শরীর গলাকাটা মুরগির মতো লাফাচ্ছে।
এগিয়ে এলেন তরুণ ছাত্ররা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি। এগিয়ে এলেন তরুণ ডাক্তার। রোগীকে কাত করে দিলেন, সিস্টার এসে অক্সিজেন দিলেন, ওয়ার্ডবয় খুলে দিলেন গায়ের গেঞ্জি, ডাক্তার সাকার মেশিন দিয়ে মুখের ভেতরে জমে থাকা লালা পরিষ্কার করে দিলেন। ছুটে এলেন ট্রলিম্যান, দ্রুততালে ট্রলি চালিয়ে তাঁকে নিয়ে এলেন ওয়ার্ডে। এত ব্যস্ততা, এত আন্তরিকতা দেখে ফরিদ ভেবেছিলেন, এঁরা কেউ মনে হয় চাচার আত্মীয়স্বজন!
সিনিয়র ডাক্তার এলেন, বললেন, হিট স্ট্রোক। সেটা আবার কী? ফরিদের বাবার হয়েছিল ব্রেইন স্ট্রোক। কিন্তু এ কোন রোগ? কত রোগ যে দুনিয়ায় আছে!
কোথা থেকে এল এক বিশাল ফ্যান, সিস্টার চালু করে দিলেন স্যালাইন, আয়া নিয়ে এলেন বরফের টুকরো ভেজানো ঠান্ডা পানি, আর তা দিয়ে কত মমতায় মুছিয়ে দিচ্ছেন চাচার বুক-পিঠ, হাত-পা, সারা দেহ। এবার ফরিদের সন্দেহ আরও দৃঢ় হলো। হাসপাতালে চাচার আত্মীয় না থেকে পারেই না। ঘণ্টাখানেক পরে চাচার একটু জ্ঞান ফিরে এল। ডাক্তার সাহেব বললেন, বিপদ আপাতত কমে গেছে। তবে দুই-এক দিন হাসপাতালে থাকতে হবে।
চাচা থাকেন টিটিপাড়া। তাঁর বাসার পাশের দোকানে মোবাইল ফোনে জানানো হলো। চাচাকে ফরিদ ২০০ টাকা দিয়ে বাড়ির উদ্দেশে বিদায় নিলেন। হূদয়ে তাঁর প্রশান্তি। কিন্তু মনে ফরিদের দুটি প্রশ্ন: হিট স্ট্রোক আবার কী রোগ? আর এরা তো চাচার কেউ না, তাহলে সবাই এত খাতির করল কেন?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর পেতে রাতের বেলায় গ্রামের মধুডাক্তারকে ফোন করলে তিনি বলেন, এমন কোনো রোগের নাম তিনি শোনেননি। ফরিদ তো আর ডাক্তার না, কী শুনতে কী শুনেছেন কে জানে! সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি ঠিক করলেন, আগে হাসপাতালে গিয়ে তারপরে অফিস যাবেন। এঁরা আজ তো দেখি রোগীর কাছে যেতে দেয় না। হাসপাতালে নাকি রাউন্ড চলছে। চলছে চলুক, তাতে কী, কী যে ফেঁকড়া!
অনেকক্ষণ পরে গেট খুলে দিলে ভেতরে গিয়ে দেখেন, চাচা দিব্বি সুস্থ। বিছানার ওপরে বসে হাসছেন আর বলছেন, সার, আপনেরে আমি বহুত দোয়া করছি, কাল আপনি না থাকলে আমার বেডা-বেডি না খাইয়া মরত। ওয়ার্ডে কোনার দিকে ফর্সা, লম্বা সাদা শার্ট পরে একজন পড়াচ্ছেন, আর তাঁর চারদিকে অল্পবয়সী ছাত্রছাত্রীরা ঘিরে দাঁড়িয়ে তাঁর কথা শুনছে আবার কেউ লিখে নিচ্ছে। দেখতে দেখতে পড়ানো শেষ। ফরিদ সম্মোহিতের মতো সেই মানুষটির দিকে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলে স্মিত হেসে তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ‘কে আপনি?’
‘আমি কাল ১২ নম্বরের রোগীকে নিয়ে এসেছি।’
‘ও, সব কথা আমি শুনেছি, সমাজের সবারই এমন দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।’
‘আমার একটা প্রশ্ন ছিল।’
‘অবশ্যই, আসুন’ বলে ডাক্তার ওনার রুমে নিয়ে গেলেন ফরিদকে।
‘স্যার, হিট স্ট্রোক সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম।’
সৌম্যকান্তি চিকিৎসক বুঝিয়ে বললেন ফরিদকে, ‘প্রচণ্ড গরমে শরীর খুব উত্তপ্ত হয়ে দুর্বলতা, বমির উদ্রেক, মাথাব্যথা, শরীর ঝিমঝিম করা, সমগ্র শরীর কষে আসা, খিঁচুনি, শ্বাসকষ্ট, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ প্রকাশ পেলে একে হিট স্ট্রোক বলা হয়। হঠাৎ করেই সমস্যাগুলো দেখা যায়। এটি একটি অতিজরুরি অবস্থা, সঙ্গে মারাত্মক পানিশূন্যতা থাকে। খেলোয়াড় বা রৌদ্রে যাঁরা কায়িক পরিশ্রম করেন (ভ্যান-রিকশা-ঠেলাগাড়ির চালক, হকার, আগুনের কাছে কাজ করেন এমন যে কেউ, কৃষক) তাঁরাই বেশি আক্রান্ত হন। শিশুরা রৌদ্রে দৌড়ঝাপ করার সময়ও আক্রান্ত হতে পারে।’
‘স্যার, রাস্তাঘাটে এ রকম রোগী পেলে কী করব?’
‘প্রথমেই তাকে ছায়া জায়গায় নিন, সব কাপড় খুলে দিন, যে রকম হোক, পানি দিয়ে অনবরত শরীর মুছে দিতে হবে, জ্ঞান থাকলে খাওয়ার স্যালাইনের পানি খাওয়ান এবং নিকটস্থ হাসপাতালে দ্রুত নিয়ে যান।’
‘কীভাবে আমরা এাই প্রাণঘাতী রোগকে এড়িয়ে চলতে পারি?’
‘প্রচণ্ড রৌদ্রে অত্যধিক কাজ করবেন না। এ সময় পর্যাপ্ত পানি পান করুন (খাওয়ার স্যালাইনের পানি খেতে পারেন), চা-কফি পান না করাই ভালো। হালকা সুতির পোশাক পরুন, পারলে ছাতা বা কৃষক ভাইয়েরা টোপা মাথায় দিন। রৌদ্রের মধ্যে দাঁড়ানো গাড়িতে, বাসে বসে না থেকে নিচে নেমে হাঁটাহাঁটি করুন। ফেরিতে এমনটা প্রায়ই হয়, তখন আপার ডেকে চলে যান। কী সুন্দর বাতাস, ছায়া আর দৃশ্য!’
‘কত দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া দরকার?’
‘যত তাড়াতাড়ি হয় তত ভালো। দেরি করলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহ স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আবার বেশি দেরিতে এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।’
‘হাসপাতাল খুব দূরে হলে কী করব?’
‘রোগীর পাশে বড় বড় বরফের চাকা রেখে বাতাস করতে থাকুন (বরফের চাকা মাছের দোকানে পাওয়া যায়)। এভাবে হাসপাতালে নিয়ে যান। জ্বর ভেবে ওষুধ দেবেন না।’
সম্মোহিত ফরিদ বেরিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর মনে আরেকটি প্রশ্ন, সেই আয়াকে পাওয়া গেল, ‘খালা, ১২ নম্বরের চাচাকে আপনি আগে চিনতেন?’
‘না রে বাপ।’
‘তাহলে সবাই মিলে অত যত্ন করছিলেন কেন?’
‘বাবা রে, সক্কল রুগীরে আমরা আমাগো পোলা-মাইয়ার মতো দেহি।’ খালা ব্যস্ত। সময় নেই। সংক্ষিপ্ত উত্তর।
বেরিয়ে এসে শহীদ মিনারের কাছে দাঁড়িয়ে আবার পেছন ফিরে চাইলেন ফরিদ, কালকের আর আজকের ফরিদের মধ্যে অনেক পার্থক্য।
চোখের সামনে বড় বড় করে লেখা ঢাকা মেডিকেল কলেজ, তার নিচে ছোট করে লেখা ‘জ্ঞানার্জনে এসো, সেবার্থে যাও’। হ্যাঁ, জ্ঞান, মমতা আর দায়িত্ববোধের এক কর্মশালা এই হাসপাতাল।

No comments

Powered by Blogger.