বাঘা তেঁতুল-এখন কোনো কিছুই চোখে লাগে না by সৈয়দ আবুল মকসুদ

এখন বাংলাদেশের যেকোনো একটি দিনের একটি সংবাদপত্রই যথেষ্ট দেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক যুগের অবস্থাটা জানার জন্য। উদাহরণের জন্য আমরা শুধু গত শনিবারের প্রথম আলো হাতে নিতে পারি। প্রথম পাতার একটি খবরে বলা হয়েছে: ‘চট্টগ্রাম মহানগরের চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) একটি ব্যাংক হিসাবে গত পাঁচ মাসে প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকা জমা হয়েছে।


...এ ছাড়া ওই ওসি প্রতিমাসে এসএ পরিবহনের মাধ্যমে কিছু টাকা ঢাকায় পাঠান বলে নিজেই স্বীকার করেন। ...ওই ওসির মাসিক বেতন ১৫ হাজার টাকা। শুক্রবার পর্যন্ত ওসি হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছয় মাসও পূর্ণ হয়নি।’
বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আমি বলে থাকি, ঘুষ-দুর্নীতি-চাঁদাবাজি-ফাঁকিবাজিতে আমাদের পুরুষেরাই বহুকাল থেকে অভ্যস্ত ও পটু। নারী ওসব থেকে এখনো দূরে। এখন দেখছি সম-অধিকারের যুগ বলেই নারীও পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠছে। কোনো থানার ওসি, কোনো উপজেলার চেয়ারম্যান, কোনো জেলার পুলিশ সুপার বা জেলা প্রশাসক যখন শুনি মহিলা, তখন খুব ভালো লাগে। কিন্তু তাঁদেরই কারও যদি পাঁচ মাসে সাড়ে আট লাখ টাকা ব্যাংক হিসাবে জমা হয়, তখন ওই খুশির খবরটিতে দুঃখ হয় না—গভীর হতাশায় ডুবে যাই।
তাঁর অর্থের উত্স ও অস্বাভাবিক লেনদেন সম্পর্কে সাংবাদিক জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি পরিচিত লোকজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাংকে জমা রাখি। এ টাকা আমার মেয়ে ও তার স্বামীর জন্য লন্ডনে পাঠাতে হয়। আমার মেয়ে ব্যারিস্টারি পড়ে। তার জন্য প্রতি সেশনে (ছয় মাস পর পর) পাঁচ-ছয় লাখ টাকা করে পাঠাতে হয়।’
খুবই খুশির কথা। আমাদের একটি কন্যারত্ন শিগগিরই ব্যারিস্টার হয়ে আসছেন দেশে—সে এক বিরাট প্রাপ্তি। যদি তিনি এসে রাজনীতি করেন তাহলে অন্য ব্যারিস্টার, যেমন—গান্ধী, জিন্নাহ, সি আর দাশ, নেহরু, সোহরাওয়ার্দীদের মতো দেশের সেবা করতে পারবেন। ওদিকে যদি না যান, তাহলে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হতে কোনো বাধা নেই। তখন প্রকাশ্যে রাজনীতি না করেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়াও সম্ভব।
আজ ‘স্থানীয় রাজনীতিক ও পুলিশের একটি চক্র কাপ্তাই-বান্দরবানসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে চোরাই পথে কাঠ পাচারে জড়িত ব্যবসায়ী, বৈধ কাঠের আড়তদার, করাতকল, বহদ্দারহাট বাস টার্নিমাল ও মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড, জুয়ার আসরসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে যে মাসোহারা আদায়’ করছে, তার অংশবিশেষ তো সত্ ও যোগ্য পাত্রপাত্রীর জন্যই ব্যয় হচ্ছে। এই ব্যারিস্টাররা যখন বিচার করবেন, তা খলিফা ওমর (রা.)-এর মতোই ন্যায়বিচার হবে। শাস্তিপ্রাপ্ত আসামি ও যত বড় অপরাধীই হোক এবং সংখ্যায় যত বেশি হোক—এক ঘণ্টায় সবাই পাবে চিরকালের জন্য জামিন।
ওসির ব্যাংক হিসাব ও মেয়েজামাই-সংক্রান্ত সংবাদের পরই দ্বিতীয় পাতায় আছে এক প্রতিমন্ত্রীর ছেলের বিয়ের খানাপিনার খবর। অকুস্থল পাবনার বেড়া উপজেলার শহীদ আবদুল খালেক স্টেডিয়াম। তারিখ ১৯ ফেব্রুয়ারি। প্রতিবেদনের শুরু এ রকম: ‘বগুড়া থেকে ভাড়া করে আনা হয় ডেকোরেটর। ছয় দিন ধরে নির্মাণ করা হয় বিশাল প্যান্ডেল ও তোরণ। ১৮টি গরু, ১০০ খাসি ও তিন হাজার মুরগি জবাই করে খাওয়ানো হয় প্রায় ২০ হাজার অতিথিকে। অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন করা হয় শতাধিক পুলিশ সদস্য। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা কয়েক দিন ধরে পরিশ্রম করে এ আয়োজন সম্পন্ন করতে সহযোগিতা করেন। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন জেলার বিভিন্ন স্থান ও অন্যান্য জেলা থেকে আসা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও স্থানীয় লোকজন। তাঁদের আপ্যায়ন করা হয় পোলাও, রোস্ট, সবজি, ঝাল মাংস ও দই দিয়ে। বেড়া উপজেলা সদরের সিঅ্যান্ডবি মোড় থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত শতাধিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়।’ ইসলামি জঙ্গিরা যদি টুইন টাওয়ার গুঁড়িয়ে দিতে পারে, বিয়েবাড়িতে হামলা করা খুবই স্বাভাবিক। সে হিসাবে শতাধিক পুলিশ কমই। কোনো রকম গোয়েন্দা-ব্যর্থতা যেন না থাকে, সে ব্যবস্থাও নিশ্চয়ই ছিল। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ ছিল কতজন তা প্রতিবেদনে নেই। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘টেলিভিশন, ফ্রিজ, ডিনার সেটসহ প্রচুর উপহারসামগ্রী পাওয়া গেছে।’ স্বর্ণালঙ্কার, প্রাইজবন্ড প্রভৃতির পরিমাণ জানা যায়নি।
নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধির ঘরে বৌমা আসছেন। ঘরের লক্ষ্মী। খুশির এই মুহূর্তে সবাই খাবে, তাতে ঢাকায় বসে কারও মন খারাপ করার কিছু নেই। তবে ওই জননেতা একুশ শতকের প্রথম নয় বছরে কত টাকা আয়কর দিয়েছেন, তা যদি এটিএম শামসুল হুদা এবং রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান না জানেন, তাহলে বুঝব রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করছে না।
বত্রিশ বছর চাকরি করার পর স্ত্রীর সামান্য গয়নাগাঁটি, ঘটিবাটি বিক্রি করে কোনো কর্মকর্তা যখন গোরান বা তল্লাবাগ ডোবার মধ্যে দেড় কাঠা জমি কিনে ওস্তাগার ডেকে কিছু ইট বসিয়ে একটি ঘর তোলেন, তখন তাঁর কাছে গিয়ে চোখ লাল করে দাঁড়িয়ে যান আয়কর বিভাগের লোক। তাঁর চোখে সন্দেহ: লোকটি চোর না হলে বাড়ি করে কীভাবে? তাঁর এক হাতে কি একটা ফাইল, আরেক হাতে নতুন গামছা—গলায় পরানোর জন্য? যাঁদের মাসে আয় লাখ লাখ টাকা, মায়ের কুলখানির জেয়াফতে ব্যয় ৫০ লাখ, বৌভাতে ব্যয় ২৫ লাখ, তাঁদের খবর রাখে না অর্থ মন্ত্রণালয়, রাজস্ব বোর্ড, নির্বাচন কমিশন, দুদক ও উচ্চতর আদালত।
ওই সংখ্যার মিজানুর রহমান খানের কলামে ‘প্রধান বিচারপতির প্রশ্নবিদ্ধ সংবর্ধনা’ সম্পর্কে কিছুই বলার নেই। মাঘ-ফাল্গুন পিকনিকের মাস। এ সময় যে কেউ পিকনিকে যেতে পারেন। র্যাফল ড্রতে অংশ নিয়ে পুরস্কার পেতে পারেন। এবং যেখানে প্রতিদিন সবাই সংবর্ধনা নিচ্ছেন, সেখানে সংবর্ধনা নিলে এবং ক্রেস্ট উপহার পেয়ে ড্রয়িংরুমে শোকেসে নিয়ে সাজিয়ে রাখলে ‘চোখে লাগা’র কিছু নেই। কারণ, এ দেশ বাংলাদেশ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.